ইউপি নির্বাচন
নির্বাচনী সংঘাতে চার মাসে ৬৬ জনের মৃত্যু
ষষ্ঠ ধাপের তফসিল ঘোষণার আগেই নবীনগরে গোলাগুলিতে গত শুক্রবার দুজন নিহত। গতকাল আটঘরিয়ায় নিহত হয়েছেন একজন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে মারামারি ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরাই এসব সংঘাতে বেশি জড়াচ্ছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ‘বিদ্রোহী’দের মধ্যে সংঘর্ষ বেশি হচ্ছে। এসব সংঘর্ষে দেশি অস্ত্র থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। গত ৪ মাসে নির্বাচনী সংঘাতে সারা দেশে ৬৬ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার দায়িত্ব প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আকস্মিক সংঘাতগুলো ঠেকানোর উপায় থাকে না। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।রফিকুল ইসলাম, নির্বাচন কমিশনার
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে। দ্বিতীয় ধাপে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। প্রথম ধাপে দুই ভাগে নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নির্বাচন হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। মূলত তখন থেকেই সারা দেশে নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়। প্রথম ধাপে ৫ জন, দ্বিতীয় ধাপে ৩০ ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ২৪ জন নিহত হন। চতুর্থ ও পঞ্চম ধাপে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে তফসিল ঘোষণার আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে গোলাগুলিতে গত শুক্রবার দুজন নিহত হন। একই দিন মাদারীপুরের কালকিনি, নোয়াখালী সদর, ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও ভোলা সদর উপজেলায় সংঘর্ষের ঘটনায় ৬২ জন আহত হন। গতকাল শনিবার পাবনার আটঘরিয়ায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের হামলায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক সমর্থক নিহত হয়েছেন।
একটি ধাপ থেকে আরেকটি ধাপের নির্বাচন ক্রমে বেশি সংঘাতময় হয়ে উঠছে। এসব সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
আপাং ও কবির দুজনই আমার ইউনিয়নের মেম্বার (ইউপি সদস্য)। তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে আগেও সংঘর্ষ হয়েছে। সকালে শুনি তাঁরা আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার দায়িত্ব প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আকস্মিক সংঘাতগুলো ঠেকানোর উপায় থাকে না। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এ পর্যন্ত সহিংসতায় সবচেয়ে বেশি, ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। ওই জেলায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেই মারা গেছেন নয়জন। অবশ্য জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মেছবাহ উদ্দিন এসব মৃত্যুর ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন। তাঁর ভাষ্য, জেলার প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলে প্রতিনিয়ত মারামারি ও খুনাখুনির ঘটনা ঘটে। তাই এসব হত্যাকাণ্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন তাঁরা।
নবীনগর ও আটঘরিয়ায় নিহত ৩
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নাটঘর ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী এরশাদুল হক (৩৫) ও বাদল সরকার (২৫) নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে গুলির চারটি খোসা উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গতকাল শনিবার ভোরে উপজেলার কুড়িগ্রাম থেকে একজনকে আটক করে পুলিশ।
ঘটনার পরপর এরশাদুল হকের প্রতিবেশী হুমায়ুন কবির ও জামাল মিয়ার বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। রাত থেকে হুমায়ুন কবির, জামাল মিয়া ও তাঁদের পরিবারের লোকজন গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁরা এরশাদুলের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত।
নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল সিদ্দিক জানান, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা এড়াতে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার দেবত্তর ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের বিরুদ্ধে। নিহত সেলিম হোসেনের (৩২) বাড়ি ইউনিয়নের শ্রীকান্তপুর গ্রামে। গতকাল সন্ধ্যায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষুব্ধ কর্মীরা লাশ নিয়ে উপজেলা সদরে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
দেবত্তর ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হামিদ মোহাম্মদ মোহাইমেন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন কে এম শাহীন। তাঁর অভিযোগ, গতকাল দুপুরে সেলিমসহ কয়েক কর্মী রাইপুর গ্রামে প্রচারে বের হন। এ সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন সেলিমসহ তাঁর কর্মীদের মারধর করেন। বিকেলে সেলিম মারা যান।
অভিযোগ অস্বীকার করে আবু হামিদ মোহাম্মদ মোহাইমেন বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এলাকায় কোনো মারধরের ঘটনা ঘটেনি। সেলিম হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
আ.লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধে৵ সংঘর্ষ
নোয়াখালী সদর উপজেলায় নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের আটজন আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে নেয়াজপুর ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামের ডিশলাইন এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল হুদা পাটোয়ারীর অভিযোগ, রাত আটটার দিকে নৌকার প্রার্থী আমির হোসেন ২০-৩০টি মোটরসাইকেল নিয়ে ডিশলাইন এলাকায় আসেন। আমির হোসেনের লোকজন এ সময় তাঁর নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর চালান। হামলায় তাঁর সমর্থক মো. শুভ, মো. মারুফ, মো. ইউনুস ও মো. সাগর আহত হন। তবে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী আমির হোসেন পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকেরা পথে তাঁর সমর্থকদের মোটরসাইকেল আটকে তাঁদের ওপর হামলা চালান।
আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। শুক্রবার রাতে সারুটিয়া ইউপিতে ওই সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ পক্ষের ৫০ জনকে আটক করেছে পুলিশ। শৈলকুপা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। সংঘর্ষের সময় নৌকার সমর্থকদের ২৫টি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন। এদিকে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকেরা অভিযোগ করে বলেন, তাঁদের সাতটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা ইউপিতে। আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় নয়জন আহত হয়েছেন। গত শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ওই ইউনিয়নের বাঘারহাট বাজারে এসব ঘটনা ঘটে। ওই ইউপিতে নৌকার প্রার্থী জহিরুল ইসলাম ও বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন।
কালকিনিতে বোমার বিস্ফোরণ
মাদারীপুরের কালকিনিতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই ইউপি সদস্যের সমর্থকের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় হাতবোমার বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হন। গতকাল সকালে উপজেলার পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়নের কালাইসরদারের চর এলাকায় দফায় দফায় এসব সংঘর্ষ হয়।
পূর্ব এনায়েতনগর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান রেহেনা নেয়ামুল বলেন, ‘আপাং ও কবির দুজনই আমার ইউনিয়নের মেম্বার (ইউপি সদস্য)। তাঁদের সমর্থকদের মধ্যে আগেও সংঘর্ষ হয়েছে। সকালে শুনি তাঁরা আবারও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]