নারী যাবেটা কোথায়?
ফরেনসিক পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তাঁর গলায় আঙুলের দাগ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর গলা টিপে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল। হাত-পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সারা পায়ে খোঁচা লাগার দাগ রয়েছে। প্রথম আলোকে এ কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ।
এই ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস থেকে নামার আগ পর্যন্ত নিরাপদ ছিলেন। বাস থেকে নামার পরই ঘটে সেই নারকীয় ঘটনা। রোববার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে বান্ধবীর বাসায় যেতে চেয়েছিলেন ওই ছাত্রী। বান্ধবীর বাসা রাজধানীর শেওড়াতে হলেও ভুল করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাস থেকে নেমে গিয়েছিলেন তিনি। মাত্র এক স্টপেজ আগে নামার জন্য তাঁকে এ খেসারত দিতে হলো।
ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর বেলায় ঘটেছে বলে তা ব্যতিক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল থেকে আন্দোলন চলছে। সোমবার বিকেলে অপরাধীকে গ্রেপ্তারের জন্য ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়ে কুর্মিটোলার সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
পরিস্থিতি এখন এমন যে ঘর থেকে বের হলেই নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমে ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের পদচারণ বেড়েছে। কাজেই তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি ক্রমে গুরুত্ব পাচ্ছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে নারীর চলাফেরা বা স্বাধীন বিচরণে নিরাপত্তার বিষয়টি এখনো প্রশ্নের মুখে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গণপরিবহনে ১৩ মাসে ২১ নারী ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে রূপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যাওয়া হয়। রূপা একটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী ছিলেন। মাত্র ১৪টি কর্মদিবসের পর টাঙ্গাইলের চাঞ্চল্যকর রূপা খাতুন ধর্ষণ ও হত্যার মামলার রায়ে চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। তবে এরপরও গণপরিবহনে ধর্ষণ, যৌন হয়রানিসহ অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। প্রতিনিয়তই বাসের ভেতরে ধারালো কিছু দিয়ে নারীর গাঁয়ের জামা কেটে দেওয়াসহ শরীরে আঘাত করার অভিযোগও করছেন নারী যাত্রীরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ থেকে নারীদের একাকী ভ্রমণের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাসে যাত্রী কম হলে সতর্ক থাকা, অধিক যাত্রীসংবলিত গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা, গাড়িতে না ঘুমানো, বাসে বসে পরিবারের কাউকে ফোন করে উচ্চ স্বরে নিজের অবস্থান জানিয়ে রাখা, গন্তব্যে যাওয়ার আগেই যাত্রীরা নেমে গেলে সেখানেই নেমে গিয়ে পরিবারের কাউকে ফোন করে এসে নিয়ে যেতে বলা, বাসা থেকে লোক না আসা পর্যন্ত প্রয়োজনে যাত্রীদের মধ্য থেকে কাউকে নির্ভরযোগ্য মনে হলে তাঁকে সেখানে থাকার জন্য অনুরোধ করা, গাড়ির ভেতরে কেউ অকারণে দরজা জানালা বন্ধ করতে চাইলে এবং অনিরাপদ বোধ করলে জাতীয় জরুরি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সহায়তা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণের শিকার শিক্ষার্থীর বেলায় এসব কিছুই খাটবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস হলো সব থেকে নিরাপদ বাহন। তিনি বিপদে পড়েছেন বাস থেকে নামার পর এবং ঘটনাটি গভীর রাতে ঘটেনি। অথচ ঢাকা শহরে বিভিন্ন প্রয়োজনে গভীর রাতেও নারীদের যাতায়াত করতে হয়।
২০১৮ সালের ঘটনা। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থী মা, খালা ও বান্ধবীদের নিয়ে রাজধানীর চাঁদনিচক মার্কেটে কেনাকাটা করতে যান। সেখানে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে নারীদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। দোকানের কর্মচারীরা তাঁদের উদ্দেশে অশ্লীল মন্তব্য করতে থাকেন। এর প্রতিবাদ জানালে ওই কর্মচারীরাসহ আরও বেশ কয়েকজন মিলে ওই নারীদের গায়ে হাত দিয়ে যৌন হেনস্তা করেন। এই শিক্ষার্থী গিয়েছিলেন মার্কেটে এবং তিনি একা ছিলেন না।
২০১৫ সালের ২০ মে বেসরকারি সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ রাজধানীর ছায়ানট ভবনে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ প্রচারাভিযানের উদ্বোধন করে। বৈশ্বিক এ প্রচারাভিযানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একশনএইডের যে গবেষণার তথ্য উল্লেখ করা হয় তাতে বলা হয়—নগরের ৪৭ দশমিক ৫ ভাগ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের ৮৮ ভাগই বলেন, তাঁরা পথচারী, পুরুষ যাত্রী ও ক্রেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন।
নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে পুলিশের সেবাকেন্দ্রগুলোর তথ্যও প্রকাশ করেছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনা যখন ঘটে তখন ভিকটিম এসব তথ্য কতটুকু কাজে লাগানোর সুযোগ পান তাও চিন্তার বিষয়। ঘটনা ঘটার পর কতটি ঘটনার ক্ষেত্রে ভিকটিম আইনের আশ্রয় নেন বা গণমাধ্যমে তা ফলাও করে প্রচার বা প্রকাশিত হয়, তা-ও একটি বড় প্রশ্ন।
২০১৮ সালে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যে বলা হয়, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব। গবেষণাটিতে সহযোগিতা করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
‘ঘটনার শিকার হলে মেয়েরা কী পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা চুপ করে থাকেন এবং ৭৯ শতাংশ বলেছেন তাঁরা আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান।
বিভিন্ন সূচক বলছে, ঢাকাও দিনদিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। আর নারীর বেলায় তা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত বছর জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি এবং অসলোর পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ উদ্যোগে 'দ্য উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি ইনডেক্স' শিরোনামে গবেষণা পরিচালিত হয়, যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম। এতে নারীর জীবনমান এবং সমাজ, গোষ্ঠী ও পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন, নিরাপত্তা সূচকসহ বিভিন্ন সূচক বিবেচনায় নেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, ৬৯ দশমিক ৯ শতাংশ নারী নিজ এলাকায় নিরাপদ বোধ করেন, যা আগের তালিকায় ছিল ৮০ শতাংশ।
বিশ্বের নিরাপদ শহরগুলোর তালিকায় (৬০ শহরের তালিকা) ঢাকার অবস্থান ৫৬তম। গত বছর যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর গবেষণা শাখা দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ‘নিরাপদ শহর সূচক-২০১৯’ প্রকাশ করে। তৃতীয়বারের মতো প্রকাশিত এ সূচকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্যাটাগরিতে ঢাকার অবস্থান ৫৫তম। ২০১৭ সালেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ৪৩তম অবস্থানে ছিল ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে। নারী কোথায় নিরাপদ? নারী যাবে কোথায়?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ শিক্ষার্থীর কিছুটা হলেও কপাল ভালো যে তিনি এখনো বেঁচে আছেন। টাঙ্গাইলের রূপার মতো তাঁকে হত্যা করা হলে কার কি-ই বা করার ছিল?