ধর্ষণের সংবাদ নিয়েও ফেসবুকে হাস্যরস কেন

ধর্ষণের মতো অমানবিক নির্যাতনের সংবাদে হাস্যরসাত্মক প্রতিক্রিয়া (রিঅ্যাকশন) জানাচ্ছেন দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একাংশ। দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর ফেসবুক পেজে ধর্ষণের সংবাদ ‘শেয়ার’ করার পর যত প্রতিক্রিয়া আসছে, তার ২৬ শতাংশ ‘হা হা’।

‘ইউজার রিঅ্যাকশনস টু রেপ নিউজ শেয়ারড অন সোশ্যাল মিডিয়া: অ্যান অ্যানালাইসিস অব ফাইভ ফেসবুক রিঅ্যাকশন বাটনস’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

ধর্ষণের সংবাদে প্রতিক্রিয়ার ২৬% হাস্যরসাত্মক। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এঁদের বোধ ও যৌন শিক্ষার অভাব রয়েছে।

এতে দেখা যায়, ধর্ষণের সংবাদে ৪৩ দশমিক ২২ শতাংশ প্রতিক্রিয়া এসেছে রাগ প্রকাশক। দুঃখ প্রকাশকারী প্রতিক্রিয়া এসেছে ২১ দশমিক ৬২ শতাংশ। ভালোবাসা–সূচক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন ৮ শতাংশের কিছু কম ব্যবহারকারী। ২ শতাংশের মতো ব্যবহারকারী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

ফেসবুকে ব্যবহারকারীর কোনো পোস্টে রাগ বা অ্যাংরি, হাসি বা হা হা, দুঃখ বা স্যাড, ভালোবাসা বা লাভ ও বিস্ময় বা ওয়াও প্রতিক্রিয়া জানানো যায়। এখন অবশ্য ফেসবুকে আরেকটি প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ যোগ হয়েছে। সেটি হলো, যত্ন বা কেয়ার। এর বাইরে ‘লাইক’ দেওয়া ও মন্তব্য করা যায়।

গবেষকেরা দেখিয়েছেন, হাসির এ প্রতিক্রিয়া ধর্ষণের প্রতি সহায়ক মনোভাব। হাসির প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একধরনের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। অন্যদিকে এক মনোবিজ্ঞানী প্রথম আলোকে বলেছেন, যাঁরা এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাঁদের বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষা, বোধ ও শিষ্টাচারের অভাব রয়েছে।

গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক মো. সাঈদ আল-জামান। তিনি বর্তমানে কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ বিষয়ে অধ্যয়নরত। গবেষণায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তাসনুভা আলম।

গবেষণা নিবন্ধটি গত ২৮ ফেব্রুয়ারি এশিয়ান জার্নাল ফর পাবলিক অপিনিয়ন রিসার্চে প্রকাশিত হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার সেন্টার ফর এশিয়ান পাবলিক অপিনিয়ন রিসার্চ অ্যান্ড কোলাবরেশন ইনিশিয়েটিভ জার্নালটি প্রকাশ করে।

গবেষণায় দেশের ১০টি গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা ৯ হাজার ৪২৯টি প্রতিবেদনে ব্যবহারকারীদের দেওয়া ৩৫ লাখ প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনগুলো ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ের। গবেষকেরা চারটি পত্রিকা ও চারটি টেলিভিশনের অনলাইন সংস্করণ এবং দুটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের ফেসবুক পেজের সংবাদে পড়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন।

গবেষণাকারী সাঈদ আল-জামান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে ফেসবুক বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। ফেসবুককে মাধ্যম করে ‘মিটু’, ‘এন্ডরেপকালচার’–এর মতো যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ফেসবুককে মাধ্যম করে একটা বড় অংশের ব্যবহারকারী যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো নির্যাতনকে উসকে দিচ্ছেন। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকে হাস্যরসাত্মক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করছেন।

অবশ্য ইতিবাচক দিকটি হলো, বেশির ভাগ মানুষই ধর্ষণের সংবাদে রাগ প্রকাশ করেছেন, দুঃখ প্রকাশ করেছেন, ভুক্তভোগীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন এবং ধর্ষণের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার মোট হার ৭৪ শতাংশ।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ধর্ষণের সংবাদে ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। রাগের প্রতিক্রিয়া বাড়লে দুঃখের প্রতিক্রিয়া কমে। আবার দুঃখের প্রতিক্রিয়া বাড়লে রাগের প্রতিক্রিয়া কমে যায়। অর্থাৎ ব্যবহারকারীরা এ দুটির মাধ্যমে ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। বিপরীতে হাসির প্রতিক্রিয়া কিছুটা বিক্ষিপ্ত ছিল। ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে হাসির প্রতিক্রিয়া কম–বেশি হয়েছে।

গবেষক সাঈদ আল-জামান বলেন, ধর্ষণের সংবাদ ফেসবুকে সাধারণ ও নিয়মিত ব্যাপার হয়ে যাওয়াটি ব্যবহারকারীদের প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ হাজার ৪১১ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।

ধর্ষণের সংবাদে হাসির প্রতিক্রিয়ার পেছনে তিনটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল। তিনিই দেশের একটি বড় অংশের মানুষের বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষার অভাবের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নারীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবমাননাকর কথা না বলা এবং তাঁদের শ্রদ্ধার চোখে দেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে ন্যূনতম আদবকেতাও জানা দরকার।

অধ্যাপক হেলাল মনে করেন, ধর্ষণের মতো সংবেদনশীল সংবাদ অনেক ক্ষেত্রে রগরগে, চটকদারভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।