চাকরি হারানো দুদক কর্মকর্তা
দুর্নীতির তদন্তে যাঁদের নাম, তাঁরাই অভিযোগকারী
কক্সবাজারে ৩ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির ঘটনায় অভিযোগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করার পরই শরীফের নামে ২০টি অভিযোগ দুদকে।
কক্সবাজারে তিনটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতির ঘটনার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়তে থাকে দুদকে। মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২০। এর মধ্যে আসামির সুপারিশ করা এক ব্যক্তিই দিয়েছেন পাঁচটি অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত শেষে ওই তিন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণে জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মোট ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগপত্র দায়ের করার সুপারিশ করেন শরীফ উদ্দিন। অভিযুক্তের তালিকায় সাবেক জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়র, বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারি দলের নেতাও রয়েছেন।
কক্সবাজারের এ তদন্তের পর শরীফ উদ্দিনের নামে তিনটি বিভাগীয় মামলাও হয়। এগুলো হলো ব্যাংক থেকে আসামি টাকা যাতে সরাতে না পারেন সে জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপককে চিঠি দেওয়া, করোনায় আক্রান্ত থাকলেও পটুয়াখালীতে যোগদানে দেরি এবং আক্রান্ত থাকা অবস্থায় মামলার নথি বুঝিয়ে না দেওয়া। এ ছাড়া ঔদ্ধত্যের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে অনীহা, জবানবন্দি না নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা করাসহ নানা অভিযোগে ১৫ থেকে ১৬টি কারণ দর্শানোর নোটিশও করা হয় তাঁকে।
এরই মধ্যে মামলার সুপারিশ করা এক আসামি শরীফ উদ্দিনকে জীবননাশের হুমকি দেন বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। এর ১৬ দিনের মাথায় গত বুধবার শরীফকে কোনো কারণ উল্লেখ না করেই চাকরিচ্যুত করে দুদক। এর আগে গত বছরের ১৬ জুন তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।
চট্টগ্রামে থাকাকালে কক্সবাজারে তিন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের দুর্নীতি ছাড়াও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির ঘটনায় অনুসন্ধান শেষে ২২টি মামলা করার সুপারিশ করেছিলেন শরীফ। দুদক সূত্র জানায়, এসব মামলার সুপারিশ গ্রহণ না করে পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সদ্য চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরাই অভিযোগ করেছেন, সবাই অনুসন্ধান ও মামলাসংশ্লিষ্ট। এগুলো যাচাই–বাছাই না করে প্রমাণ হওয়ার আগেই চাকরি থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, তিনি অনুসন্ধান শেষে বেশির ভাগই মামলার সুপারিশ করতেন। যদি আপস করতেন, তাহলে আজ তাঁর বিরুদ্ধে এত কিছু হতো না।
এদিকে শরীফকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে ‘জাগ্রত ছাত্রসমাজ, কক্সবাজার’ নামের একটি সংগঠন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচি থেকে অবিলম্বে তাঁর অপসারণ আদেশ বাতিল করে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়।
৮ মাসে ২০ অভিযোগ
কক্সবাজারে প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনায় ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য গত বছরের জুনে দুদকে সুপারিশ করেছিলেন শরীফ উদ্দিন। এরপর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে তাঁর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগ জমা পড়ে দুদকে। এর মধ্যে মো. ইদ্রিস নামের এক ব্যক্তি দিয়েছেন পাঁচটি অভিযোগ। এই ইদ্রিস কক্সবাজারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা তুলে নেন বলে অভিযোগ আছে। তাঁকে তখন দুদক গ্রেপ্তারও করে। জামিনে বের হয়ে ইদ্রিস তাঁকে অন্যায়ভাবে দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, ঘুষ দাবি ও কক্সবাজারে বিভিন্ন হোটেলে চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে শরীফের বিরুদ্ধে গত বছরের আগস্টে পাঁচটি অভিযোগ দেন দুদকে। এই ইদ্রিস নিজেকে সিআইপি (বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) পরিচয় দেন।
পাঁচটি অভিযোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করে মো. ইদ্রিস গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগের কী হয়েছে, জানি না। সুষ্ঠু তদন্ত চাই।’ তাঁর দাবি, পিবিআই প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।
শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের আরেকজন হলেন কক্সবাজারের বাহারছড়ার নুরুল হক। পিবিআই প্রকল্পে জাল–জালিয়াতির মাধ্যমে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা তুলে নেন বলে শরীফের তদন্তে উঠে আসে। এই নুরুল হকও পরে দুদকে অভিযোগ করেন, শরীফ তাঁর কাছে ঘুষ দাবি ও তাঁকে অন্যায়ভাবে দুর্নীতির ঘটনায় জড়িয়েছেন।
তবে শরীফ উদ্দিন অভিযোগপত্রের যে সুপারিশ করেছেন, তাতে বলা হয়েছে, আসামি সেলিম উল্লাহ ও কক্সবাজার ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াসিম খান আদালতে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাতে জালিয়াতির মাধ্যমে মো. ইদ্রিস ও নুরুল হক যে টাকা তুলে নিয়েছেন, সে তথ্য উঠে আসে।
শরীফের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগকারীদের বাকিরাও তাঁর অনুসন্ধান কিংবা মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে আছেন কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমানে অবসরোত্তর ছুটিতে) আইয়ুব খান চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সারওয়ার হোসেন, সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ও সাবেক ব্যবস্থাপক মো. মজিবুর রহমান। অবৈধ গ্যাস–সংযোগ দেওয়াসহ দুর্নীতির অভিযোগে এঁদের বিরুদ্ধে গত বছরের জুনে মামলা করা হয়েছিল। যার কারণে তাঁরা শরীফের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এর মধ্যে আইয়ুব খান চৌধুরী চট্টগ্রামের শরীফের বাসায় গিয়ে হুমকি দেন বলে থানায় জিডি হয়েছে।
অভিযোগকারীদের মধ্যে আছেন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। কক্সবাজারের তিন প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনায় শরীফ যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়ার সুপারিশ করেন, তাতে মুজিবুর রহমানও আছেন।
এ ছাড়া সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলামের বড় ছেলে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য মো. মুজিবুর রহমান ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ফয়সল ইকবাল চৌধুরীও পৃথক অভিযোগ দিয়েছেন। এই দুজনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করেছিলেন শরীফ। সর্বশেষ গত মাসে পটুয়াখালী থেকে একটি বেনামে অভিযোগ দুদকে আসে। সেখানে শরীফের বিরুদ্ধে কোটি টাকার চাঁদাবাজি, গাড়ি, বাড়ি ও সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ করা হয়। অভিযোগকারী যে মুঠোফোন নম্বর দিয়েছেন, সেটি ১০ ডিজিটের, ভুয়া।
বিভাগীয় মামলা
দুদক সূত্র জানায়, শরীফের বিরুদ্ধে কক্সবাজারে প্রকল্পে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার আসামি বেলায়েত হোসেনের হিসাবে থাকা ঘুষের ৫০ লাখ টাকা ক্রোকের জন্য আদালতে আবেদন না করে, ব্যাংক ব্যবস্থাপককে লিখিত চিঠি দিয়ে সেটা আটকানোর (ফ্রিজ করা) কারণে প্রথম বিভাগীয় মামলা হয়। গত বছরের আগস্টে এই বিভাগীয় মামলা হয়, যা এখনো তদন্তাধীন।
এ বিষয়ে শরীফ উদ্দিন দুদককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, আদালতে আবেদন করার আগে দুদক থেকে অনুমতি নিতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ। আসামি যাতে তড়িঘড়ি করে টাকাগুলো উত্তোলন করতে না পারেন, সে জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে তিনি ব্যাংক ব্যবস্থাপককে চিঠি দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিভাগীয় মামলাটি হয় পটুয়াখালীতে বদলির আদেশের ৪০ দিন পর কেন সেখানে যোগদান করলেন, সে কারণে। এ ক্ষেত্রে শরীফ দুদককে লিখিতভাবে জানান, ওই সময় তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে বদলির আদেশ হওয়া আরও ২০ কর্মকর্তাও একই সময়ে স্ব স্ব কর্মস্থলে যোগদান করেছিলেন। তবে তাঁদের কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি চাকরিবিধি অনুযায়ী অনিবার্য কারণবশত বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগদানকাল সর্বোচ্চ ৩০ দিন বর্ধিত হতে পারে। করোনায় আক্রান্ত থাকার সনদ (চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের সত্যায়িত করা) জমা দেওয়ার পরও এই বিভাগীয় মামলা হয়।
তৃতীয় বিভাগীয় মামলাটি হয় বদলির আদেশের পরও ২৫টি মামলার নথি বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগে। এ বিষয়ে শরীফ তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, নথি বুঝে নেওয়ার জন্য তাঁকে চট্টগ্রাম থেকে অবমুক্তির প্রাক্কালে গত বছরের ৩০ জুন তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। করোনার কারণে ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা হয়। ১৯ জুলাই তাঁর করোনা ধরা পড়ে। বিভাগীয় মামলায় গত বছরের ২২ আগস্ট নির্দেশপ্রাপ্তির পর নথি হস্তান্তরের ২ মাস ২১ দিন বিলম্বের অভিযোগ ভ্রান্তিকর।
শরীফের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রামের পরিচালক মাহমুদ হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
চাকরিচ্যুত দুদক কর্মকর্তা শরীফের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের নাম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করার পেছনে থাকা লোকজন প্রভাবশালী। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য পুরস্কৃত না হয়ে যদি তিরস্কারের শিকার হতে হয়, সেটা দেশের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে।