>• উড়ালসড়কের সুবিধা পেতে অতিরিক্ত চারটি র্যাম্পের সুপারিশ করা হয়
• প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয় ২৩৪ কোটি টাকা
• দুটি র্যাম্প দিয়েই কাজ শেষ করেছে সিডিএ
চট্টগ্রাম নগরের আখতারুজ্জামান চৌধুরী উড়ালসড়কের সুফল পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত চারটি র্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) নির্মাণের সুপারিশ করেছিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গঠিত ‘নকশা পর্যালোচনা কমিটি’। এ জন্য প্রকল্প ব্যয় ২৩৪ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। কিন্তু দুটি র্যাম্প নির্মাণ না করেই প্রকল্পের কাজ শেষ করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম দাবি করেছেন, র্যাম্পগুলো নির্মাণে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, র্যাম্পগুলো নির্মাণ করা হবে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মনির হোসেনও জানিয়েছেন, সিডিএ দুটি র্যাম্প বাদ দিয়েছে। তাঁরা উড়ালসড়কের কাজ শেষ করেছেন।
তবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, চারটি র্যাম্প নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর নকশা অনুযায়ী সবগুলো র্যাম্প অবশ্যই নির্মাণ করতে হবে। না হলে উড়ালসড়ক নির্মাণের সুফল পাওয়া যাবে না। একই কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরাও।
সিডিএ চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর, দুই নম্বর গেট ও জিইসি মোড়ে তিনটি উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য দেড় শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০১০ সালের ১ জুন একনেকে অনুমোদন পায়। পরে এর পরিবর্তে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত একটি উড়ালসড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর ৪৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের অধীনে চার লেনের মূল উড়ালসড়কের সঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী সড়কে একটি র্যাম্প ও একটি লুপ ছিল। নির্মাণকাজ শুরুর পর উড়ালসড়কের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এই উড়ালসড়ক কার্যকর করতে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলমকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের পর প্রকল্প ব্যয় ২৩৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬৯৬ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর একনেকের সভায় দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধিত এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
পর্যালোচনা কমিটি মূল নকশার বাইরে জিইসি মোড় এলাকায় আরও চারটি র্যাম্প নির্মাণের সুপারিশ করে। এর মধ্যে প্রথম দুটির একটি হচ্ছে জিইসি মোড় থেকে মুরাদপুর ও বায়েজিদ বোস্তামী যাওয়ার জন্য নাসিরাবাদের সামনে এবং অন্যটি মুরাদপুর ও বায়েজিদ বোস্তামী থেকে আসা গাড়িগুলোর জন্য স্যানমার ওশান সিটির সামনে। এ ছাড়া লালখান বাজার থেকে জিইসি মোড় ও জাকির হোসেন সড়কমুখী গাড়িগুলো নামার জন্য জিইসি কনভেনশন সেন্টারের সামনে একটি এবং জিইসি মোড় থেকে লালখান বাজারের দিকে যাওয়ার জন্য পেনিনসুলার একটু সামনে আরেকটি র্যাম্প নির্মাণ করার কথা ছিল।
২০১৭ সালের ১৬ জুন কোনো র্যাম্প ও লুপ নির্মাণ ছাড়াই মূল উড়ালসড়ক যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে বায়েজিদ বোস্তামীমুখী লুপ ও র্যাম্প, স্যানমার ওশান সিটির সামনে র্যাম্পের কাজ শেষে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। গত বছরের ২২ নভেম্বর নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের র্যাম্পটি খুলে দেওয়া হয়। জিইসি কনভেনশন সেন্টার ও পেনিনসুলার সামনের র্যাম্প নির্মাণ করা হয়নি। এখন প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম নেই।
জিইসি মোড়ে দুটি র্যাম্পের বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, এ দুটি র্যাম্প পরবর্তী সময়ে নির্মাণ করা হবে। নির্মাণব্যয় পর্যালোচনা এবং র্যাম্প প্রয়োজনীয়তা আছে কি না তা সমীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজন হলে নির্মাণ করা হবে। আর বাড়তি টাকা পুরো প্রকল্প ব্যয়ের জন্য বলে দাবি করেন তিনি।
সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল উড়ালসড়ক লালখান বাজারে নামিয়ে দেওয়ায় র্যাম্প দুটি নির্মাণ করা হচ্ছে না। এখন লালখান বাজার থেকে জিইসি মোড়ের অল্প দূরত্ব কম সময়ে পার হওয়া যাচ্ছে। তাই এখানে দুটি র্যাম্প কার্যকর হবে না। র্যাম্প নির্মাণ না করায় যে ২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে তা সিডিএর তহবিলে থাকবে।
দুটি র্যাম্প নির্মাণ না করা সত্ত্বেও মাত্র ২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, রাস্তা সংস্কারসহ অন্যান্য কাজে বাকি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে।
যোগাযোগ করা হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্তের মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেন, সিডিএ বলছে দুটি র্যাম্প নির্মাণ করবে। কিন্তু এর তো কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। যদি র্যাম্প নির্মাণ করা না হয় তাহলে খুবই খারাপ হবে। কেননা উড়ালসড়কের পরিপূর্ণ সুফল আসবে না।
সাবেক এ মন্ত্রী আরও বলেন, র্যাম্প দুটি নির্মাণ করা হলে নগরের খুলশী ও জাকির হোসেন সড়কমুখী গাড়িগুলো মূল উড়ালসড়ক দিয়ে চলে যেতে পারত। আবার এই এলাকার গাড়িগুলো মূল উড়ালসড়ক হয়ে লালখান বাজারে যেতে পারত। কিন্তু র্যাম্প না থাকায় গাড়িগুলোকে নিচের রাস্তা দিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে যানজট হচ্ছে।
চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ মাহমুদ ওমর ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি পর্যালোচনা করেই বলেছিল, মূল উড়ালসড়কের কোথায় কোথায় কতগুলো র্যাম্প লাগবে। এখন তা যদি পুরোপুরি করা না হয় তাহলে স্বাচ্ছন্দ্যে যান চলাচল করতে পারবে না। প্রকল্পের পুরো সুফল পেতে হলে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করতেই হবে।