২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দুই ভাইয়ের ত্রাসের রাজত্ব

আফজাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন
আফজাল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন

আপন দুই ভাই। একজন কিশোরগঞ্জ-৫ (নিকলী-বাজিতপুর) আসনের সাংসদ মো. আফজাল হোসেন, অন্যজন তাঁর ছোট ভাই বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হোসেন (আশরাফ)। মাত্র এক দশকে এই সহোদর হয়ে উঠেছেন গোটা এলাকার নিয়ন্ত্রক। প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, মামলা, মাদক ব্যবসা, খুন, নারী নির্যাতন থেকে শুরু করে খাসজমি, দোকানপাট, বাড়িঘর, বালুমহাল দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি এতই ভীতিকর যে, কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাহস পান না।

তবে সাংসদ আফজাল হোসেন ও মেয়র আনোয়ার হোসেন এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে, যার কোনো সত্যতা নেই।

নিকলী ও বাজিতপুরের আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার আগে আফজাল হোসেনের আওয়ামী লীগের সদস্যপদ পর্যন্ত ছিল না। দলের একটা বড় অংশের বিরোধিতার মধ্যেই তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হয়ে ওঠেন ছোট ভাই আনোয়ার। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে পরের বছর পৌরসভা নির্বাচনে সাংসদ তাঁর ভাইকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান।

দলীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, আনোয়ার হোসেন বাজিতপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর শুরু করেন প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও দখলবাজি। ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পর্ষদের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে ২০১২ সালের জুন থেকে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন।

>

সাংসদ আফজাল ও তাঁর ভাই পৌর মেয়র আনোয়ারের কর্মকাণ্ডে সন্ত্রস্ত বাজিতপুরবাসী

সর্বশেষ গত ২১ আগস্ট সাংসদের ক্যাডার যুবলীগ নেতা আনিসুর রহমান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ঘোড়াউত্রা নদীতে বালুমহাল দখলের সময় প্রতিপক্ষের তিন ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করে পাল্টা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ মার্চ জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সাংসদ ও মেয়রের অনুসারীদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা বিল্লাল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। ভাগলপুর ফায়ার সার্ভিস অফিসের কাছে নিজ বাড়িতে পরিবারের লোকজনের সামনে পিটিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধার দুই হাত ও এক পা ভেঙে দেওয়া হয়।

নির্যাতনের শিকার এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমার জমি নিয়ে এমপি সাহেবের উপস্থিতিতে দরবার হয়েছে। তিনি নিজেই বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাকে মারার পর তিনি একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।’

জানতে চাইলে সাংসদ আফজাল বলেন, ‘এ ঘটনায় আমার ভাইয়ের সম্পৃক্ততা আমরা কিছুটা পেয়েছি। কিন্তু এর জন্য মূলত দোষী কিন্তু সে (বিল্লাল মিয়া)। যে ছেলেটা মারছে, সে আবার আমার ভাইয়ের সঙ্গে চলাফেরা করে। এইটা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব।’

আর মেয়র আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘উনি (বিল্লাল মিয়া) জাল দলিল করে গরিব লোকের জমি আত্মসাৎ করা লোক। ওনাকে আহত করছে বাড়ির পাশের লোকেই।’

২০১৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাজিতপুর উপজেলার দিলালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মিজবাহউদ্দিনের ওপর মেয়রের লোকজন হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা তাঁকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়। এ ঘটনায় করা মামলার ১ নম্বর আসামি মেয়র আনোয়ার। এরপর টানা দুই বছর মিজবাহউদ্দিন এলাকায় যেতে পারেননি।

সাংসদ আফজাল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘এইটা তাঁদের দুজনের (মেয়র ও মিজবাহউদ্দিন) ব্যাপার। ওঁরা কেউ ভালো লোক না। ঘটনার পর আমি যতটুকু জানছি, মীমাংসা করার চেষ্টা করেছি।’

খাল ও মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জায়গা দখল

বাজিতপুর বাজারে কয়েক বছর আগে সাংসদ আফজাল হোসেন তাঁর নিজের নামে একটি পাঁচতলা বিপণিবিতান গড়ে তোলেন। বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ৫০ শতক জায়গার ওপর তৈরি এই মার্কেট সম্প্রসারণের জন্য সাংসদ এলাকার পাঁচজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে দোকান থেকে উচ্ছেদ করেছেন। পাশাপাশি সামনের অংশে প্রবাহমান খালের জায়গা ভরাট করেন। এ ছাড়া মার্কেটের কাছেই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের জন্য নির্ধারিত খাস জায়গাটি এখন নিজের বলে দাবি করছেন।

বাজিতপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ইউনিট কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, খাস জায়গায় কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন, নকশা তৈরি, টাকা বরাদ্দ—সবকিছুই হয়ে গিয়েছিল। এখন এমপি সাহেব বলছেন এই জায়গা নাকি তাঁর ভাই কিনেছেন।

জানতে চাইলে সাংসদ বলেন, যে জায়গাটার কথা বলছেন, তা নিয়ে প্রথম দিকে একটু বিতর্ক ছিল। সেখানে ব্যক্তিমালিকানার জায়গা আছে, খাল আছে, খাসজমিও আছে। আর বিপণিবিতান নির্মাণের জন্য ব্যবসায়ীদের দোকান উচ্ছেদ ও খাল ভরাট প্রসঙ্গে সাংসদ বলেন, ‘মার্কেটের জায়গাটা আমি তিন-চারজন মালিকের কাছ থেকে কিনেছি। খালের জায়গা ছেড়েই আমার ভবন করা।’

কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক নেতা রেজাউল হকের ভাষ্য, এলাকার সবকিছুই দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। একবার কেউ সাংসদ বা তাঁর ভাইয়ের প্রতিপক্ষ হয়ে গেলে আর রক্ষা নেই।

জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আলাউল হক বলেন, ‘প্রশাসন, থানা সবকিছুই চলে সাংসদের কথা অনুসারে। এখানে সবাই বোবা হয়ে আছেন।