দশকের পর দশক প্রতারণার হাতিয়ার ম্যাগনেটিক পিলার আসলে কী
ম্যাগনেটিক পিলার বা রাইস–পুলার পিলার—এই নামে গুগলে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে ভূরি ভূরি লিংক। বেশির ভাগই কল্পকথা, কিছু বিজ্ঞাপন। এর মধ্যেও ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ম্যাগনেটিক পিলার বা রাইস–পুলার পিলারের নামে প্রতারণা নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।
এসব প্রতিবেদনে স্থান পাওয়া গল্পগুলো অনেকটা একই রকম। যেমন ২০১৮ সালের ৯ মে টাইমস অব ইন্ডিয়া নাসার নাম ব্যবহার করে রাইস–পুলার পিলার বিক্রির জন্য বাবা–ছেলেকে গ্রেপ্তারের খবর ছেপেছিল। এই প্রতিবেদন প্রকাশের সপ্তাহখানেক আগে তারা দুই ব্যবসায়ীর প্রতারিত হওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাঁদের একজন প্রায় দেড় কোটি রুপি এবং অন্যজন ৩৯ লাখ রুপি খোয়ান। তাঁদের টোপ দেওয়া হয়েছিল এই বলে যে নাসা ৩৭ হাজার কোটি রুপি দিয়ে পিলার কিনবে। বাংলাদেশেও দশকের পর দশক এ ধরনের প্রতারণা ঘটছে। এসব ঘটনা বিভিন্ন সময়ে খবরের শিরোনামও হয়েছে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছে মূলত বাংলাদেশ ও ভারতে। ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনও আছে। যেমন রাইসপুলার ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে সরাসরি ছয়টি পিলার বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দেখা যায় সম্প্রতি। বিজ্ঞাপনদাতা বলেছেন, তাঁর কাছে ছয়টি ম্যাগনেটিক পিলার আছে। এগুলো ১৮১৮ সালের। পিলারগুলো যথাক্রমে ১১, ২২, ১২ দশমিক ৭৫, ১৪, ১২ ও ৮ দশমিক ৫ ইঞ্চি দূরে থাকা চালকে আকর্ষণ করতে পারে। কোথাও কোথাও বলা হচ্ছে, ম্যাগনেটিক পিলারের ভেতরে ইরিডিয়াম নামের একটা ধাতু আছে। ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা আসলে এই ইরিডিয়ামের। ইরিডিয়াম চালকে আকর্ষণ করে।
পিলারগুলো নিয়ে আরও একটা প্রচার আছে। বলা হয়, এই পিলারগুলো ভূমির সীমানা নির্ধারণের জন্য বসানো হয়েছিল। তবে এর বজ্রনিরোধক শক্তি ছিল। লোভে পড়ে মানুষ পিলারগুলো সরিয়ে নিয়েছে, ফলে দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়েছে।
জিনিসটা আসলে কী
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এসব পিলার বসানো হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলে। এ বিষয়ে কথা হচ্ছিল ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও ভূমি বিশেষজ্ঞ ফায়েকুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের কয়েক বছর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমবারের মতো ভূমি জরিপের উদ্যোগ নেয়। প্রায় ৭০–৮০ বছর ধরে চলা ওই জরিপ ‘থাকবাস্ট’ জরিপ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
ফায়েকুজ্জামান চৌধুরী বলেন, তিনটি মৌজা যে বিন্দুতে গিয়ে মিলেছে, সেখানে একটি করে পিলার বসানো হয়েছিল। এতে চুম্বক থাকার কথাও শোনা যায়। ঘোর বর্ষা বা বন্যায় পিলার ডুবে গেলে যেন অন্য কোনো ধাতু দিয়ে পিলারটি চিহ্নিত করা যায়, এই ছিল উদ্দেশ্য।
থাকবাস্ট জরিপের পর আরও দুটি জরিপ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এর একটি রেভিনিউ জরিপ ও অন্যটি ক্যাডাসট্রাল সার্ভে, যেটিকে সিএস জরিপ বলা হয়। রেভিনিউ জরিপের সময় কিছু মাটির ঢিবিও বসানো হয়। সে কারণে এই জরিপ ঢিবি জরিপ নামেও পরিচিত ছিল।
এই ভূমি বিশেষজ্ঞ বলেন, সীমানা চিহ্নিত করতে বসানো পিলার বা মাটির ঢিবিতে অলৌকিক কিছু ছিল, এমন কোনো প্রমাণ নেই। তবে নানা প্রচার আছে।
এটা প্রমাণের কোনো উদ্যোগ কি কখনো নেওয়া হয়েছিল? জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর আগেও প্রতারকদের গ্রেপ্তার করে ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলার পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কাছে।
ড. বিলকিস আরা বেগম পরমাণু শক্তি কমিশনে আছেন ১৯৯৯ সাল থেকে। সংস্থাটির পরিচালক এখন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে তাঁর উপস্থিতিতে অন্তত ১০টি পরীক্ষা হয়েছে। এই পিলারগুলোর কিছু অংশ নিয়ে তাঁরা এক্স–রে ফ্লুরোসেন্স টেকনিক ব্যবহার করে দেখেন কী কী উপাদান আছে। এখন পর্যন্ত ক্যালসিয়াম, আয়রন, সিলিকন, টাইটেনিয়াম পেয়েছেন। কোনো কোনোটির ভেতর শুধু আরসিসি রডও ছিল। ইরিডিয়াম ছিল না।
এই ইরিডিয়াম আসলে কতটা দুর্লভ? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ইরিডিয়ামের ব্যবহার সীমিত। যেমন একাধিক ধাতুর মিশ্রণে নতুন শক্তিশালী ধাতু তৈরিতে ইরিডিয়াম কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ইরিডিয়াম থেকে কিছুটা আলো বের হয়। কিন্তু এ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি ডাহা মিথ্যা কথা।
ম্যাগনেটিক পিলার কি বজ্রপাত নিরোধ করত
এ খবর জানতে লন্ডনের আবহাওয়া বিভাগে ই–মেইল করেছে প্রথম আলো। ফিরতি ই–মেইলে কোনো পিলার কখনো বজ্রপাত নিরোধে কাজ করত তা কি না, জানা নেই বলে জানিয়েছে তারা। এই পিলারগুলো কবে, কখন, কোথায়, কেন বসানো হয়েছিল, সে সম্পর্কে জানতে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয় তারা। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ই–মেইলের প্রাপ্তি স্বীকার করলেও ২৬ মে পর্যন্ত কোনো জবাব দেয়নি।
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে যুক্তরাজ্যের প্রাচীনতম উদ্যোগ সম্পর্কে অনলাইনে বেশ কিছু প্রবন্ধ পাওয়া যায়। লাইটেনিং স্ট্রাইক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, বজ্রপাতের প্রথম উল্লেখ করেন পারস্যের রাজা জারজিকসের (রাজত্বকাল ৪৮৬–৪৬৫) পরামর্শক আরটেমিস। তিনি লিখেছিলেন, নগরের সবচেয়ে উঁচু দালান ও গাছে বজ্রপাত হয়।
বজ্রপাত রোধে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় ১৭৫৭ সালে প্রথম উদ্যোগ নেন বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন। ভবনের ওপর লাইটেনিং রড বা একধরনের ধাতব রড স্থাপন করে বজ্রপাত ও বিদ্যুৎকে টেনে নিয়ে সেটিকে মাটিতে পৌঁছে দেওয়ার বুদ্ধি আসে তাঁর মাথা থেকে। তবে যুক্তরাজ্যে কার্যকর পদক্ষেপের ভাবনা আসে আরও পরে। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, ১৮০৩ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির বেশ কিছু জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে। লাইটেনিং রড সম্পর্কে নীতিমালা আসে রয়্যাল মেটেওরোলোজিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনের পর ১৮৭৮ সালে।
কিন্তু ২০১৩ সালে খুলনার পাইকগাছা এবং ২০১৯ সালে পিরোজপুরে যে ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলার পাওয়া গিয়েছিল, সেটির গায়ে লেখা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮১৮।
ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলার নিয়ে জনশ্রুতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরও এর সত্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বজ্রপাত থেকে মৃত্যুরোধে একটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তাঁদের পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগ গবেষণা করে। তারা জানিয়েছে, ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলার বজ্রপাত রোধ করে, এমন কোনো প্রমাণ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান তৌহিদা রশিদ জানান, আগে বজ্রপাত হতো বিকেলের দিকে। এর প্রকোপ থাকত মার্চ থেকে মে–জুন পর্যন্ত। এখন দিনের যেকোনো সময় বজ্রপাত হচ্ছে এবং প্রকোপ থাকছে ফেব্রুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা যত বাড়বে, বজ্রপাতের সংখ্যা আর প্রাণহানির ঝুঁকিও তত বাড়বে। এর সঙ্গে ম্যাগনেটিক পিলার বা বর্ডার পিলারের কোনো যোগসূত্র নেই।
কিন্তু ম্যাগনেটিক পিলারে কথিত ‘অলৌকিক বস্তুর’ (ইরিডিয়াম) খোঁজ থেমে নেই। প্রতারণাও চলছে সমানে। জনৈক মি. এনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এই বেপরোয়া খোঁজ। তিন দশক ধরে এর খোঁজে লাখ লাখ টাকা খোয়ানো মানুষটি বললেন, ‘৯৯ ভাগ মানুষই ম্যাগনেটিক পিলারের কথা বলে ঠকায়। কিন্তু ১ ভাগ মানুষ সত্যিই এই পিলারের সন্ধান জানেন—এটাই আমার বিশ্বাস।’