তিনি 'ক্যাসিনো সাঈদ'
তিনি যুবলীগ নেতা, আবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাউন্সিলর। এলাকায় গড়েছেন একক আধিপত্য। জড়িয়ে পড়েছেন ক্যাসিনো–বাণিজ্যে। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগও আছে। প্রভাব খাটিয়ে বনে গেছেন বিভিন্ন ক্লাবের নেতা।
যুবলীগের এই বিতর্কিত নেতার নাম এ কে এম মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তিনি যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক। ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হলেও তিনি বোর্ড সভায় নিয়মিত যেতেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া অসংখ্যবার বিদেশে গেছেন। এখনো তিনি সিঙ্গাপুরে। তাঁকে অপসারণ করতে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে চিঠি দিয়েছে ডিএসসিসি।
>কাউন্সিল হলেও সভায় যান না
অনুমতি ছাড়া বারবার বিদেশ ভ্রমণ
চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগও আছে
ক্যাসিনো–বাণিজ্য
গত বুধবার রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবে অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাব সূত্র জানায়, এই চারটি ক্লাবের মধ্যে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবটি চালাতেন যুবলীগের বিতর্কিত নেতা মমিনুল হক। এই ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো, জুয়া, মাদকের আসর বসত।
র্যাবের অভিযানের পরপরই মমিনুল হক সিঙ্গাপুরে পালিয়ে গেছেন বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানান, সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডে মমিনুল হকের ক্যাসিনোর ব্যবসা আছে। মাসে দু–তিনবার তিনি বিদেশে যাওয়া–আসা করেন। ফকিরাপুল ও আরামবাগের অনেকেই তাঁকে ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামে চেনেন।
মতিঝিল থানা থেকে সামান্য দূরেই ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। এখন সেখানে তালা ঝুলছে। আরামবাগের প্রবীণ বাসিন্দা ও কেবল ব্যবসায়ী তানভির আলম জানান, মমিনুল হকের উত্থান হয় মতিঝিল ও আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজি করে। ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেন। এই ক্লাব পরিচালনায় তাঁর সঙ্গী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসার। এ ছাড়া আরও চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোর ব্যবসা ছিল সাঈদের নিয়ন্ত্রণে।
রোববার এ বিষয়ে জানতে মমিনুল হকের কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ওয়ার্ডের সচিব মো. রফিক জানান, মমিনুল হক সিঙ্গাপুরে আছেন। তবে কবে এবং কেন গেছেন, তা তিনি স্পষ্ট করে বলেননি।
মমিনুল হক গতকাল সোমবার ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ফকিরাপুল ও আরামবাগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনো ব্যবসার যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে, তা সঠিক নয়। তাঁর দাবি, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব পরিচালনা করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা কাউসার। এই ক্লাবের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নেই।
র্যাবের নির্বাহী হাকিম সারোয়ার আলম জানান, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব থেকে ১০ লাখ টাকা, অনেকগুলো মদের বোতল, স্বর্ণের আংটি ও চেইন জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্লাবের তিনজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরাসহ অজ্ঞাতনামা ২০–২৫ জনকে আসামি করে মতিঝিল থানায় মামলা হয়েছে।
কারণ দর্শানোর নোটিশ
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত ডিএসসিসিতে ১৮টি বোর্ড সভা হয়। এগুলোর মধ্যে মাত্র ৫টি সভায় উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর মমিনুল হক। ডিএসসিসি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তিনি তা মানেন না। গত ২৫ জুন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় সরকার বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, পরপর তিনবার বোর্ড সভায় অনুপস্থিতি কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য অপরাধ এবং অসদাচরণের শামিল। বিষয়টি উল্লেখ করে গত ৭ জুলাই তাঁকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতার তদবিরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন শাখা-১–এর কর্মকর্তা (উপসচিব) আ ন ম ফয়জুল হক বলেন, মমিনুল হক নোটিশের জবাব দিয়েছেন। মন্ত্রী কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। তাই এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
গত ২৩ জুন বিনা অনুমতিতে মমিনুল হকের বিদেশ ভ্রমণ আটকাতে পুলিশের বিশেষ শাখার বিশেষ পুলিশ সুপারকে চিঠি দেয় ডিএসসিসি। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি আবার বিনা অনুমতিতে সিঙ্গাপুরে গেছেন বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে চিঠি দিয়ে জানানোরও পর তিনি কীভাবে বিদেশে যান, তা বোধগম্য নয়। অথচ তাঁর এমন কর্মকাণ্ডে জনগণ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রশাসনিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে।
তবে অনুমতি ছাড়া বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে মমিনুল হক বলেন, কাউন্সিলর ছাড়াও তিনি বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁর বিদেশ যাওয়ার অনুমতি আছে। ছেলের চিকিৎসার জন্য তিনি এখন সিঙ্গাপুরে আছেন বলে জানান।
আরও যত অভিযোগ
ফকিরাপুল, আরামবাগ এলাকাটি নিয়ে ডিএসসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের প্রতিটি গলির মাথায় লোহার গেট লাগিয়েছেন কাউন্সিলর মমিনুল হক। পাহারা দেওয়ার জন্য নিরাপত্তাকর্মীও নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। বিনিময়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে এলাকার বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে চাঁদা নিচ্ছেন তাঁর লোকজন।
আরামবাগ গরম পানির গলির একজন মুদি ব্যবসায়ী বলেন, দোকান বা প্রতিষ্ঠানের আয়তন অনুযায়ী চাঁদা নির্ধারণ করে দিয়েছেন মমিনুল হকের লোকজন। চাঁদা না দিলে হুমকি–ধমকি ও ব্যবসা পরিচালনায় বাধা দেওয়া হয়।
২০১৬ সালে প্রভাব খাটিয়ে কমলাপুর স্টেডিয়াম ও গোপীবাগ বালুর মাঠে দুটি কোরবানির পশুর হাট ইজারা নিয়েছিলেন এই কাউন্সিলর। অথচ সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, কোনো কাউন্সিলরের এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার নিয়ম নেই। পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ইজারা বাতিল করে ডিএসসিসি।
মতিঝিল ও আশপাশের এলাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে মমিনুল হকের বিরুদ্ধে। গত শনিবার ও গতকাল সোমবার এই এলাকায় সরেজমিনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। মতিঝিল শাপলা চত্বর এলাকার হকার এবং লাইনম্যান এমদাদ হোসেন বলেন, কাউন্সিলরের লোকজন চাঁদার টাকা নেন। কিন্তু তিনি কার হাতে চাঁদার টাকা দেন, তা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
গত ২৬ আগস্ট ডিএসসিসির বোর্ড সভায় অংশ নিয়েছিলেন মমিনুল হক। এই সভায় তিনি এলাকার উন্নয়নকাজ তদারকির ব্যাপারে আগ্রহ দেখান। তখন ডিএসসিসির মেয়র বলেন, আইন অনুযায়ী তদারকির দায়িত্ব প্রকৌশল দপ্তরের। এই দায়িত্ব কাউন্সিলরদের নয়। পরে বক্তব্যের একপর্যায়ে মমিনুল হক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।
ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা বলেন, আগে এলাকার উন্নয়নকাজ তদারক করতেন ওয়ার্ড কাউন্সিলররাই। তখন তাঁরা ঠিকাদারের কাছে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতেন। টাকা না দিলে কাজ বন্ধ করে দিতেন। তাই মন্ত্রণালয় কাউন্সিলরদের তদারকির ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
আরো পড়ুন :