ডাকাতে ডাকাতে খুনোখুনি
কামাল হোসেন (২৪), ইমন শেখ (২৫), মো. মনির হোসেন (২৭) ও মো. ফরিদ (২৫) ছিলেন চার বন্ধু। তাঁরা কখনো রংমিস্ত্রি, কখনো গাড়ির চালক বা চালকের সহকারীর কাজ করতেন। কামাল, ইমন ও ফরিদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। মনিরের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়। পেশার কারণে এই চার যুবকের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়। তবে সম্পর্কের গভীরতার আসল কারণ ছিল ডাকাতি। চারজনই দিনের বেলায় শ্রমজীবী থাকলেও রাতের বেলা হয়ে যেতেন ভয়ংকর। পথেঘাটে ডাকাতি, লুট—সবই করতেন তাঁরা। ডাকাতি করতে গিয়ে পরস্পরের বন্ধুত্বে ভাঙন দেখা দেয়। একসময় নিজেরা হত্যার নেশায় মেতে ওঠেন। এরই জের ধরে কামাল ও ইমনকে কুপিয়ে হত্যা করেন মনির ও ফরিদ।
গত ২০ অক্টোবর রাতে তুরাগ থানাধীন উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর প্লটে কাশবনের মধ্যে কামাল ও ইমনের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে উদ্ধার করে তুরাগ থানার পুলিশ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো বঁটি ও রড উদ্ধার করা হয়। তবে দুটি লাশই অর্ধগলিত ও চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় শনাক্তে জটিলতার মধ্যে পড়ে পুলিশ। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পরদিন ২১ অক্টোবর লাশ দুটি শনাক্ত করেন কামাল ও ইমনের স্বজনেরা।
এ ঘটনায় কামালের বাবা শেখ জলিল বাদী হয়ে তুরাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। তুরাগ থানার পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়াতদন্তে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) উত্তর বিভাগ। কোনোভাবেই মামলাটির সুরাহা না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিবির উত্তর বিভাগের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও প্রতিরোধ টিমকে।
ডিবি উত্তরের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এক মাসেরও বেশি সময় তদন্তের পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজধানীর আদাবরের ঢাকা উদ্যান এলাকা থেকে গত ৩০ নভেম্বর বিকেলে মনিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিন রাত সাড়ে ১১টায় শনির আখড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ফরিদকে। মামলার তদন্ত এবং দুই আসামির স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে আসে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের মূল বিষয়।
যে কারণে হত্যা
মামলার তদন্ত ও ডিবির কাছে আসামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কামাল হোসেন, ইমন শেখ, মনির হোসেন ও ফরিদ একটি ডাকাত দল গঠন করেন। তাঁদের সঙ্গে রেজাউল ও আল-আমিন নামের আরও কয়েকজন ছিলেন। এই যুবকেরা রাজধানীর তুরাগ এলাকার বেড়িবাঁধ ও উত্তরা এলাকায় ডাকাতি করতেন। কখনো কখনো ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোয় সড়কে চলাচলকারী যানবাহন থামিয়ে ডাকাতি করতেন।
ডিবি উত্তরের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, দিনের বেলা তাঁরা পেশা বদল করতেন। কিন্তু গভীর রাতে প্রথমে সড়কে কাঠের গুঁড়ি ও বড় পাথর ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশার পথরোধ করত এই ডাকাত দল। তারপর ধারালো দা, বঁটি, লোহার রড ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল সেট ও স্বর্ণালংকার লুট করত। ডাকাতির মালামাল ভাগাভাগি করত তারা। কামাল ও ইমন ডাকাতির বেশির ভাগ মালামাল নিজেদের কাছে রেখে দিতেন। এ নিয়ে অন্যদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। সর্বশেষ ফরিদপুরে একটি ডাকাতির মালামাল ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে কামাল ও ইমনের সঙ্গে ফরিদ ও মনিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। এরই প্রতিশোধ নিতে তাঁরা কামাল ও ইমনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। ফরিদ ও মনির এই হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।
যেভাবে হত্যা করা হয়
গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় কামাল হোসেন ও ইমন শেখকে নিয়ে মনির, ফরিদ ও রেজাউল ডাকাতি করতে উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরে জড়ো হন। রাত নয়টার দিকে ১৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর প্লটে কাশবনের ভেতর দিয়ে যেতে থাকেন। একপর্যায়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, বঁটি ও রড দিয়ে কামাল ও ইমনকে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে থাকেন মনির ও ফরিদ। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে দৌড়ে পালিয়ে যান রেজাউল। প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট কোপানোর পর মৃত্যু নিশ্চিত করে কামাল ও ইমনের লাশ ফেলে পালিয়ে যান মনির ও ফরিদ। পালানোর সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বঁটি ও রড পাশে ঝোপে ফেলে দেন তাঁরা।
যেভাবে পালিয়ে থাকেন হত্যাকারীরা
ডিবির তথ্যমতে, ফরিদ ও মনিরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পরপরই গা ঢাকা দেন তাঁরা। মনির গাবতলী এলাকায় নিজের বাসা ছেড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকেন। ফরিদ রাজধানী ছেড়ে প্রথমে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা এবং পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চলে যান। সেখানে গিয়েও আবারও ডাকাতির পরিকল্পনা করতে থাকেন। ফরিদের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের বিভিন্ন থানায় একাধিক ডাকাতির মামলা রয়েছে।