চাল সিন্ডিকেটের জালে টিআর-কাবিখা প্রকল্প
চাল ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং বাজারে চালের দাম কমে যাওয়ায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের জন্য নেওয়া টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। বিশেষ করে এ প্রকল্পের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য সোলার প্যানেল স্থাপন করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। অন্তত পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় এমন পরিস্থিতি প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে।
উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টেস্ট রিলিফ (টিআর) এবং গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের জন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের প্রতি টন চালের সরকার-নির্ধারিত দাম ৩৫ হাজার ৪৮১ টাকা। আর এক টন চালের বর্তমান বাজারমূল্য ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু মঠবাড়িয়ায় ব্যবসায়ীরা প্রতি টন চাল ১৪ হাজার টাকার বেশি দামে কিনতে নারাজ। ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেটে যুক্ত আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাও। স্থানীয় সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজীর দাবি, তিনি এই সিন্ডিকেট ভাঙতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
>এক টন চাল:
৩৫,৪৮১ টাকা সরকারি দাম
২৫০০০ টাকা বাজারদর
১৪০০০ টাকায় কিনছেন ব্যবসায়ীরা
প্রতি টনের বিপরীতে সোলার প্যানেল দিতে হয় দুটি, দাম ২৬০০০ টাকা
নথিপত্রে দেখা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মো. রুস্তম আলী ফরাজী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় টিআর প্রকল্পের জন্য ৪৬৬ টন এবং কাবিখা প্রকল্পের জন্য ৪৪২ টন চাল বরাদ্দ পান। এই চাল আসার খবর পেয়ে স্থানীয় কয়েকজন চাল ও গম ব্যবসায়ী নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে কম দামে চাল কিনতে এককাট্টা (সিন্ডিকেট) হন। এর সঙ্গে সরকারদলীয় লোকজনও যুক্ত হন। এই সিন্ডিকেট গত বছর প্রতি টন চাল ১৬ হাজার টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। মানে প্রতি কেজি ১৬ টাকা। ফলে সরকার-নির্ধারিত দামের চেয়ে অর্ধেক দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হন প্রকল্প কমিটির সভাপতিরা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে সাংসদ আবার ৩০০ টন বিশেষ ও ১৫৪ টন সাধারণ টিআর এবং ৩০০ টন বিশেষ ও ১৬৬ টন সাধারণ কাবিখা বরাদ্দ পান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশেষ বরাদ্দকৃত টিআর ও কাবিখার অর্ধেক (৩০০ টন) বিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা, হাটবাজার, ইউনিয়ন পরিষদ ও জনসাধারণের বাড়ি, যেখানে বিদ্যুৎ-সুবিধা নেই, সেখানে সোলার সিস্টেম (সৌরবিদ্যুৎ) স্থাপন করতে হবে। কিন্তু এবার বাজারে ধান-চালের দাম কমে যাওয়ায় এবং ক্রেতা সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় প্রতি টন চাল ১৪ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে প্রকল্প কমিটি।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ বরাদ্দের ৩০০ টন চাল বিক্রি করে উপজেলায় প্রায় ৫০০ প্রতিষ্ঠান ও দুস্থ পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্থানীয় সাংসদের করে দেওয়া প্রকল্প কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের নামে ওই চাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রকল্প কমিটির সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তা সংস্কার, বিদ্যালয়ের মাঠ ভরাট, পুকুর খননের কাজে নয়ছয় করা যায়; কিন্তু সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেল কিনতে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই।
এই দাবির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তাফালবাড়িয়া গ্রামের সৌরবিদ্যুতের একটি প্রকল্পের সভাপতি মো. আরিফের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘প্রতি টন চাল বেচে দুটি সোলার প্যানেল কিনতে হবে। প্রতিটি ১৩ হাজার টাকা করে দুটি প্যানেলের দাম ২৬ হাজার টাকা। কিন্তু প্রকল্পের এক টন চালে ১৪ হাজার টাকার বেশি দেন না ব্যবসায়ীরা। এখন ২৬ হাজার টাকা পুরাব কোথা থেকে?’
একই প্রশ্ন উপজেলার বড় মাছুয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আশ্রাফ আলীর। তাঁর গ্রামের ১৬টি দুস্থ পরিবারকে সৌরবিদ্যুতের সুবিধা দেওয়ার জন্য আট টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। ঘাটতি মেটানো নিয়ে তিনিও উদ্বিগ্ন।
উপজেলার খায়ের ঘটিচোরা হামিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার মাঠ ভরাটের জন্য দুই টন খাদ্যশস্য (চাল) বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সরকারি হিসেবে ওই চালের সরকার-নির্ধারিত মূল্য ৭০ হাজার ৯৬২ টাকা। প্রকল্প কমিটির সভাপতি মাদ্রাসার সুপার আবদুর রহমানকে বরাদ্দের চাল বাজারে বেচে এই পরিমাণ টাকার কাজ করতে হবে। কিন্তু চাল বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ২৮ হাজার টাকা। চালের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তিনি নিজের পকেট থেকে আরও ২০ হাজার টাকা খরচ করেছেন বলে দাবি করেন। এরপরেও কাজের মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।
পরিস্থিতি কি আসলেই এমন—জানতে চাইলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. ফাইজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার-নির্ধারিত অর্থনৈতিক মূল্য ও স্থানীয় বাজারমূল্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ছাড়া চালের মান খারাপ এবং চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম আরও কমিয়ে দেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।’ তিনি বলেন, খাদ্যশস্যের পরিবর্তে টাকা বরাদ্দ পেলে এ সমস্যা এড়ানো যায়।
প্রকল্প কমিটির সভাপতি এবং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্য, যাঁরা বিভিন্ন প্রকল্পের সভাপতি, এমন অন্তত ৪৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তৌহিদুল বাশার, ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন, কামাল মল্লিক, জামাল মল্লিক, সিদ্দিকুর রহমানসহ কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী মিলে টনপ্রতি ১৪ হাজার টাকায় চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেন। তবে এই সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্তত দুজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, সরকারি দলের লোকজন কম দামে চাল কেনার সিন্ডিকেট করেছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত অমান্য করার সাহস কারও নেই।
তবে সিন্ডিকেটে নাম থাকা চাল ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘সিন্ডিকেট একসময় ছিল, এখন আর নেই। বাজারে চালের দাম কমে যাওয়ায় প্রতি টন চাল ১৩ থেকে ১৪ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা প্রতি টনে মাত্র এক হাজার টাকা লাভ করি।’
আরেক চাল ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেট সদস্য জামাল মল্লিক বলেন, ‘ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করায় চালের বাজার পড়ে গেছে। এ কারণে কম মূল্যে চাল কিনতে হচ্ছে।’
চাল সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেট নাই। আমি তাদের (চাল ব্যবসায়ী) সাহায্য-সহযোগিতা করি। কেউ এর বেশি দামে কিনলে তাকেও সাহায্য করব।’ তিনি বলেন, ‘বাগেরহাট ও বরগুনার মোকামেই এই চালের দাম কম। টন ১৫-১৬ হাজার টাকার বেশি চলে না। আপনারা মোকামে কথা বলেন।’
উপজেলার তুষখালী ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাহান হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কয়েক মাস আগে উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় চাল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘চাল ব্যবসায়ীদের কম দামে চাল কেনার সিন্ডিকেট ভাঙার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। তাই সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হচ্ছে।’