গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল পাপিয়ার

শামিমা নূর পাপিয়া।
শামিমা নূর পাপিয়া।

কোনো ছবিতে চুল উঁচু করে বেঁধে নরম সোফায় লাঠি হাতে বসে আছেন শামিমা নূর ওরফে পাপিয়া। আবার কোনো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। যুব মহিলা লীগের এই নেত্রীর এমন ছবিতে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। রাজনীতির মাঠে তিনি সক্রিয়। দলীয় সব কর্মসূচিতে তাঁকে দেখা যেত। তিনি হঠাৎ কেন গ্রেপ্তার হলেন? গতকাল রোববার এ প্রশ্নের জবাব দিতে দ্বিতীয় দিনের মতো সংবাদ সম্মেলন করে র‍্যাব। তবে এসব প্রশ্নের জবাব তারা খোলাসা করে দিতে পারেনি।

শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া (২৮), তাঁর স্বামী মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮) ও তাঁদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবা (২২) গ্রেপ্তার হন। র‍্যাবের দাবি, তাঁরা পালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গ্রেপ্তারের পর গতকালই পাপিয়াকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগ। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূরকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলো।

এ নিয়ে গতকাল কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র‍্যাব-১-এর অধিনায়ক শাফিউল্লাহ বুলবুল। তিনি জানান, পাপিয়ার নামে কোনো মামলার খবর র‍্যাব জানে না। তবে তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে দু-তিনটি খুনের মামলা থাকতে পারে। পাপিয়া জাল টাকা ও অবৈধভাবে টাকা পাচার ও অবৈধ অস্ত্র রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধ করেছেন। কোথায় কত টাকা পাচার করেছেন জানতে চাইলে শাফিউল্লাহ বুলবুল সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে পাপিয়ার ছবি থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেউ তুলতে চাইলে ভদ্রতা করে ছবি তোলা হয়। এর বেশি কিছু নয়। পাপিয়া পাঁচ তারকা মানের বিভিন্ন হোটেলে নারীদের দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন বলে অভিযোগ করেছে র‍্যাব। ওই সব কর্মকাণ্ডের কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। ওই ভিডিও দেখিয়ে পাপিয়া কি কাউকে প্রতারণা করছিলেন? এমন প্রশ্নেরও সরাসরি জবাব এড়িয়ে গেছেন শাফিউল্লাহ। তিনি বলেছেন, বেশ কিছু নারীর ভিডিওক্লিপ তাঁরা পেয়েছেন। ক্লিপগুলো কোনো নারীর জন্যই মর্যাদাকর নয়। শামিমা যাঁদের জন্য নারীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নেরও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

>

র‌্যাব বলছে, সম্পদশালী এই নারী অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত
যুব মহিলা লীগ থেকে বহিষ্কার

পাপিয়ার নামে কেউ অভিযোগ করার পর র‍্যাব মাঠে নেমেছে কি না জানতে চাইলে শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়ার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। এ তথ্যের ভিত্তিতেই তাঁরা অভিযান চালিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে রোববার ভোর চারটায় র‍্যাব অভিযান চালায়। একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বুকিং দেওয়া বিলাসবহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুট রুম এবং ইন্দিরা রোডের ফ্ল্যাট থেকে র‍্যাব ১টি বিদেশি পিস্তল, ২টি পিস্তলের ম্যাগাজিন, ২০টি পিস্তলের গুলি, ৫ বোতল দামি বিদেশি মদ ও ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, ৫টি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, কিছু বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি ভিসা ও এটিএম কার্ড উদ্ধার করে। র‍্যাব জানায়, পাপিয়া এবং তাঁর স্বামীর মালিকানায় ইন্দিরা রোডে দুটি ফ্ল্যাট, নরসিংদীতে দুটি ফ্ল্যাট ও ২ কোটি টাকা দামের দুটি প্লট, তেজগাঁওয়ে এফডিসি ফটকের কাছে গাড়ির শোরুমে ১ কোটি টাকার বিনিয়োগ ও নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামের প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে।

অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, জাল নোট সরবরাহ, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থ পাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। র‌্যাব বলছে, গত ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে এই দম্পতি পাঁচ তারকা হোটেলের কয়েকটি বিলাসবহুল কক্ষে অবস্থান করেন। এ জন্য তাঁরা পরিশোধ করেন ৮১ লাখ ৪২ হাজার টাকা। র‌্যাবের দাবি, এই অর্থের উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি এই দম্পতি।

নরসিংদীর বাড়িতে নীরবতা
নরসিংদী শহরের ভাগদী এলাকায় পাপিয়াদের দোতলা বাড়ি। গতকাল সেখানে তাঁর বাবা ও বড় ভাই ছিলেন। বড় ভাই সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, তিনটি গাড়িতে করে র‌্যাব সদস্যরা শনিবার রাতে এসেছিলেন। তাঁরা পাপিয়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কার ওয়াশ সেন্টারের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখে চলে যান।

পশ্চিম ব্রাহ্মন্দী এলাকায় সুমনের বাড়িতে গিয়েও প্রায় একই চিত্র পাওয়া যায়। পরিবারটির সবাই বাড়ি তালাবদ্ধ করে ঢাকায় চলে গেছেন। স্থানীয় লোকজন জানান, পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান বা প্রয়োজনে সুমন ও পাপিয়া এই বাড়িতে মাঝেমধ্যে আসেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের অন্তত ১০ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। তাঁরা বলেন, ২০০৬ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় পাপিয়ার সঙ্গে সুমনের সম্পর্ক হয়। ২০০৯ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকেই তাঁরা স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১০ সালে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক করা হয় পাপিয়াকে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তাঁকে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।