ওসি মোয়াজ্জেমকে রংপুরে সংযুক্তি, প্রতিবাদে মানববন্ধন
মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ওসিকে জুতা প্রদর্শন করা হয়েছে।
আজ শনিবার দুপুরে শহরের লালবাগ এলাকায় বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে এ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পুণ্যভূমি রংপুরে নুসরাত হত্যার সাহায্যকারী ওসি মোয়াজ্জেমের ঠাঁই হবে না। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে রংপুর রেঞ্জ থেকে প্রত্যাহার ও হত্যার ঘটনায় জড়িত সবাইকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তাঁরা।
এদিকে গতকাল শুক্রবার গণমাধ্যমে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে সংযুক্তির খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে রংপুরবাসী।
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় চার পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতি ও অসদাচরণের প্রমাণ পেয়েছিল পুলিশেরই তদন্ত কমিটি। সেই কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ৯ দিন পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ফেনীর পুলিশ সুপার ও সোনাগাজী থানার দুই উপপরিদর্শকের (এসআই) বিরুদ্ধে কমিটি ব্যবস্থা নিতে বললেও তাঁরা এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
গত ৬ এপ্রিল নুসরাত জাহানকে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করেন মাদ্রাসার একদল ছাত্রছাত্রী। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় তাঁরা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেন। এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া এবং মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এমনকি জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম জাহাঙ্গীর আলম অভিযুক্ত ওসিকে রক্ষায় ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য পাঠান পুলিশ সদর দপ্তরে।
বিষয়গুলো নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্তর সমালোচনা হয়। এর মধ্যে নুসরাতের পরিবারের দাবির মুখে প্রথমে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে বদলি করা হয়। পরে এ ঘটনায় পুলিশের দায়দায়িত্ব খতিয়ে দেখতে ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম রুহুল আমিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৩০ এপ্রিল কমিটি তাদের প্রতিবেদন পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে জমা দেয়।
প্রতিবেদনে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম ও এসআই ইকবালকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার ও এসআই আবু ইউসুফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও তাঁদের নন অপারেশনাল ইউনিটে বদলির সুপারিশ করা হয়।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন ও এসআই ইকবাল হোসেন নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচারের কাজে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন। এসপি জাহাঙ্গীর আলম সরকার সকাল ১০টায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার খবর পেয়েও ঘটনাস্থলে যাননি। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে রওনা দেন। পরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজির নির্দেশে মাঝপথ থেকে ফিরে আসেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি কে এনামুল কবীরও তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ সোনাগাজী থানার ওসির বিরুদ্ধে। তা হলো অদক্ষতা, পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, দায়িত্বে অবহেলা ও অসদাচরণ। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে শ্লীলতাহানি করেছেন, এটা জানার পরও কোনো ব্যবস্থা নেননি ওসি। ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ করেন নুসরাত। এরপর সোনাগাজী থানায় যাওয়ার পর নিয়ম ভেঙে তাঁর বক্তব্য ভিডিও করেন ওসি। ভিডিও করার সময় নুসরাত দুই হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কাঁদছিলেন। এ সময় ওসি বলতে থাকেন, ‘মুখ থেকে হাত সরাও। কান্না থামাও। এমন কিছু হয়নি যে এখনো তোমাকে কাঁদতে হবে।’
এদিকে নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প দিনের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংস্থাটি এ পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ৮ আসামি ছাড়াও ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের ১৮ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।