শুধু এনামুল বা রুপনই নন, তাঁদের আরও তিন ভাইসহ পাঁচজনে মিলে মতিঝিলে জমজমাট ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তাঁদের হাত ধরেই মতিঝিলের ক্লাবগুলোয় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার প্রসার ঘটে। পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
পুরান ঢাকার ক্যাসিনো ব্যবসায়ী এই পাঁচ ভাই হলেন—শহিদুল হক ভূঁইয়া, রশিদুল হক ভূঁইয়া, মেরাজুল হক ভূঁইয়া, এনামুল হক ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া। তাঁদের বাড়ি ওয়ারীতে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, পুরান ঢাকার দুই ভাই এনামুল হক ও রুপনের নামে গত বছর চারটি মামলা হয়। মামলার তদন্তে উঠে এসেছে, কেবল এনামুল-রুপন নন, তাঁরা মোট পাঁচ ভাই ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।
এনামুল ও রুপন ভূঁইয়া কারাগারে। বাকি তিন ভাই পলাতক।
এনামুল হকরা সাত ভাই, এক বোন। তাঁদের বাবার নাম সিরাজুল হক ভূঁইয়া। সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, সিরাজুল হকের একসময় পুরান ঢাকার বাংলাবাজার ও রাজশাহীতে লাইব্রেরির ব্যবসা ছিল। সিরাজুলের ছিল তাস খেলার অভ্যাস। একসময় তিনি নিয়মিত আজাদ বয়েজ ক্লাবে তাস খেলতেন। পরে তিনি নিজে তাস খেলার বোর্ড পরিচালনা করা শুরু করেন। বছর পাঁচেক আগে ২০১৪ সালে সিরাজুল হকের সাত ছেলের মধ্যে প্রথমে এনামুল ও রুপন মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ওয়ানটেন খেলার বোর্ড চালানো শুরু করেন। প্রথমে দুই ভাই মোট চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। প্রায় তিন বছর এই ব্যবসা তাঁরা চালিয়ে আসছিলেন। তখন ওয়ানটেন বোর্ড পরিচালনা করে প্রতিদিন গড়ে ১২ হাজার টাকা আয় করতেন।
মোবারক নামের এক ব্যক্তি এনামুল ও রুপনের ওয়ানটেন বোর্ড কিনে নেন। সে সময় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের পাশের ভিক্টোরিয়া ক্লাব, মালিবাগ সৈনিক ক্লাব ও পল্টনের জামাল টাওয়ারে ক্যাসিনো ব্যবসা চালু ছিল। ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ক্যাসিনো পরিচালনা করতেন নেপালি নাগরিক হ্যারি। হ্যারির সঙ্গে মোবারকের পরিচয় ছিল। এনামুল ও রুপনের সঙ্গে হ্যারির পরিচয় করিয়ে দেন মোবারক। হ্যারির মাধ্যমে এনামুল ও রুপন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন। হ্যারি বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। ২৪ ঘণ্টা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসা চলত।
সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এনামুল ও রুপনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন হারুন অর রশীদ। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে এই দুই ভাই তাঁদের অনুগত কর্মচারীদের দিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এই ব্যবসার সঙ্গে তাঁদের তিন ভাই রশিদুল, শিপলু ও শহীদুল সরাসরি জড়িত ছিলেন। এর বাইরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সেক্রেটারি জয়গোপাল সরকারকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা দিতেন এনামুল-রুপন।
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো ব্যবসায় কার কী ভূমিকা ছিল, সে ব্যাপারে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, জয়গোপালের পক্ষে টাকা সংগ্রহ করতেন সাইফুল ইসলাম। সাইফুল না থাকলে টাকা ওঠানোর কাজ করতেন নবীর হোসেন শিকদার। আর মোবারক ছিলেন ক্যাসিনো বোর্ডের সেক্রেটারি। মোবারক প্রতিদিন ১৫০০ টাকা পেতেন। রুপনের শ্যালক আলী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। বুলু নামের যুবক ক্যাসিনোর একটি বোর্ড পরিচালনা করতেন। আর করিম নামের এক ব্যক্তি স্থানীয় লোকজনকে ম্যানেজ করতেন। বিনিময়ে তাঁর বেতন ছিল প্রতিদিন ১৫০০ টাকা। আর এনামুল-রুপনের সব থেকে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন পাভেল রহমান নামের এক ব্যক্তি। পাভেলের পরামর্শে এনামুল ও রুপন ১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা কর্মচারী হারুন অর রশিদের বাসায় রেখে আসেন। যে টাকা পরে র্যাব জব্দ করে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাজিম উদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘এনামুল হকসহ পাঁচ ভাই মিলে ক্যাসিনো ব্যবসা গড়ে তোলে। বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে তারা। আমরা ইতিমধ্যে এনামুল ও রুপনের নামে থাকা জমি, ফ্ল্যাটগুলো চিহ্নিত করেছি। ব্যাংক হিসাবে থাকা টাকার পরিমাণ জানা গেছে। আমরা এনামুল, রুপনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলা করেছি। ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে আয় করা সব সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।’