এখন আতঙ্ক ও ভয়ের জনপদ নানিয়ারচর
>• আতঙ্ক দূর করতে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভা
• সভায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি কম ছিল
• নানিয়ারচর বাজারে দোকানপাট খুললেও ক্রেতাশূন্য
নানিয়ারচর ডাকবাংলো এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে চেংগী নদী। উপজেলা সদরে যাওয়ার জন্য খেয়া পার হয়ে অন্তত ১৫ মিনিট হাঁটতে হয়। আলপথ ধরে দুটি বাঁশের সাঁকো ডিঙালে নানিয়ারচর বাজার। বাজারের বেশির ভাগ দোকান খোলা। দোকানিরা কেউ ঝিমাচ্ছেন, কেউবা বসে আছেন উদ্বেগভরা চেহারা নিয়ে। শুধু বাজার নয়, উপজেলা পরিষদে যেতে যেতে চোখে পড়েছে আতঙ্ক ও জনমানবহীন এক জনপদ।
২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার পৃথক ঘটনায় রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজনের খুনের ঘটনায় এত আতঙ্ক ভর করেছে তাঁদের মাঝে। আতঙ্ক এবং ভয় দূর করতে গতকাল শনিবার বিকেলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মনির-উজ-জামানের উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বিশেষ সভার আয়োজনও করা হয়। নানিয়ারচর বাজারে অনুষ্ঠিত এই সভায় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারসহ নানা আশ্বাস থাকলেও মানুষজন তাতে কতটা সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, তা তাদের চেহারা দেখে স্পষ্ট। তা ছাড়া এই সভায় স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ছিল একেবারে নগণ্য।
ডিআইজি এস এম মনির-উজ-জামান সভায় বলেন, ‘আমরা আপনাদের সাহস জোগাতে, শক্তি জোগাতে এসেছি। অচিরেই সব শক্তি দিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। গ্রেপ্তার করে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা দৃশ্যমান হবে। অনেক রক্ত ঝরেছে, আর নয়। আমরা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন করব।’
ডিআইজি আরও বলেন, ‘নিরাপত্তা বিধান করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও ব্যর্থতার দায়ভার বহন করতে আমরা দ্বিধান্বিত নই।’
কান্নায় ভেঙে পড়েন ভাইস চেয়ারম্যান
বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কোয়ালিটি চাকমা। শক্তিমান চাকমার মৃত্যুর ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কী কথা বলব। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জনগণ আমাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। জনগণই আমাদের নিরাপত্তা দেবে।’ এরপর তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অপর ভাইস চেয়ারম্যান রণবিকাশ চাকমা নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এই সভায় সরকারি চিকিৎসক নুপুর কান্তি দাশ স্থানীয় বাসিন্দাদের পাশাপাশি নিজেদের নিরাপত্তাও দাবি করেন।
হত্যার পর উল্লাস করে খুনিরা
উপজেলা পরিষদের ১০০ গজের মধ্যে নানিয়ারচর থানা। দোতলায় উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়। বৃহস্পতিবার সকালে এই উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) সহসভাপতি শক্তিমান চাকমাকে। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের সামনেই তাঁকে গুলি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা পরিষদের দারোয়ান মো. ইউসুফ বলেন, ‘আমি দোতলায় ছিলাম। হঠাৎ টায়ার বিস্ফোরণের মতো একটা শব্দে চমকে উঠি। এরপর আরও কয়েকটা শব্দ পেয়ে দোতলা থেকে বের হই। বারান্দায় এসে নিচে তাকাতে দেখি একজন পড়ে রয়েছেন। আঙিনার ওপাশ দিয়ে দু-তিনজন দৌড়ে পালাচ্ছেন। পরে নিচে এসে দেখি চেয়ারম্যান পড়ে রয়েছেন। খুনিরা খাদ ডিঙিয়ে পাহাড়ের দিকে গিয়ে উল্লাস করেছে।’
নিজ আঙিনায় চেয়ারম্যানকে হত্যার পর থেকে আতঙ্ক বিরাজ করছে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে।
মুখ খুলছেন না কেউ
নানিয়ারচর বাজার, উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল চলছে। বিশেষ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় যোগ দেওয়া লোকজনকে বারবার অনুরোধ করা হলেও কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলেননি। সেখানে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ইউপি সদস্য।
নানিয়ারচর বাজারেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। বাজারটি ক্রেতাশূন্য দেখা গেছে। দোকানিরা জানান, বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে লোকজন আসছেন না। তাই বাজারে কোনো ক্রেতা দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন উপজেলা সদরের এই বাজারটি জমজমাট থাকে বলে দোকানিরা জানালেন।
কাপড়ের দোকানি রাজমনি দাশ বলেন, শক্তিমানের খুনের ঘটনার পর থেকে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। এরপর আবার পাঁচজনকে খুন করার পর নিরাপত্তা একেবারেই নেই। তিনি বলেন, ‘আজ (কাল) বিকেল তিনটা পর্যন্ত মাত্র ১০ টাকায় একটি রুমাল বিক্রি করেছি।’
শেষকৃত্য সম্পন্ন
শক্তিমান চাকমার শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় শুক্রবার সকালে নিহতদের চারজনের শেষকৃত্য গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। ওই ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে মাইক্রোবাসচালক মো. সজীব হাওলাদারের লাশ গ্রামের বাড়ি বরিশালে পাঠানো হয়েছে। অপর চারজনের মধ্যে তপন জ্যোতি চাকমা ও টনক চাকমার শেষকৃত্য গতকাল দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরের তেতুলতলা শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়।
সুজন চাকমা ও সেতু চাকমার শেষকৃত্য খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার যথাক্রমে মুবাছড়ি ও উপজেলা সদরে সম্পন্ন হয়।
শুক্রবার মাইক্রোবাসযোগে শক্তিমানের শেষকৃত্যে যাওয়ার সময় নানিয়ারচর উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের বেতছড়ি এলাকায় তাঁদের ওপর সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। এতে পাঁচজন নিহত এবং সাতজন আহত হন। এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করে জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) এবং ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দল।
মামলা হয়নি
পরপর দুটি খুনের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নানিয়ারচর থানায় কোনো মামলা হয়নি। জানতে চাইলে রাঙামাটি সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, একটু গুছিয়ে দুই ঘটনায় মামলা করা হবে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তার নেই।
নানিয়ারচরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন তালুকদার বলেন, এখানে ইউপিডিএফ, জনসংহতি (এম এন লারমা), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক—তিনটি দলই খুব সক্রিয়। তাদের আধিপত্যসংক্রান্ত সমস্যার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
রাঙামাটিতে দুই দিনের হরতাল
পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের ডাকে আজ রোববার তিন পার্বত্য জেলায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হবে। এ ছাড়া কাল সোম ও পরশু মঙ্গলবার তিন পার্বত্য জেলায় ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ। এপ্রিলে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা ও মহালছড়িতে তিন বাঙালি ব্যবসায়ী অপহরণ এবং বাঙালি মাইক্রোবাসচালককে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে এই হরতালের ডাক দেওয়া হয় বলে জানান সংগঠনের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম।
এ ছাড়া খাগড়াছড়ি জেলায় আজ সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে পার্বত্য অধিকার ফোরাম এবং পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ।
ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান
পাহাড়ি জনপদে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষ বন্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। পার্বত্যবাসীর দুই নেতা শক্তিমান চাকমা, তপন জ্যোতি চাকমাসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা ও আহত করার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত গতকাল এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।
রানা দাশগুপ্ত ওই সব ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার ও আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান।