একই কায়দায় আক্রমণ, দায় স্বীকার

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, অধ্যাপক শফিউল ইসলাম এবং সর্বশেষ অভিজিৎ রায়কে হত্যা। প্রতিটি ঘটনায় আক্রমণের ধরন একই রকম। প্রত্যেককে পেছন থেকে অতর্কিতে ঘাড়ে ও মাথায় ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
তিনটি ঘটনায়ই ইন্টারনেটে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি এসেছে। প্রথম ঘটনার পর ফেসবুকে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে, পরেরটিতে ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ ও সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়।
অবশ্য আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে বাংলাদেশে একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার কথা জানা গেলেও ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ বা ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামে কোনো সংগঠনের নাম শোনা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায়কে গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টায় দুর্বৃত্তরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এর আড়াই ঘণ্টার মাথায় রাত ১২টার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এ হত্যার দায় স্বীকার করে টুইট করা হয়। এতে বলা হয়, ‘আল্লাহু আকবর..বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন..’।
এরপর এক টুইটে ‘এক্সক্লুসিভ!’ শিরোনামে হামলার পর মাটিতে লুটিয়ে থাকা অভিজিৎয়ের পাশে তাঁর স্ত্রীর রক্তাক্ত একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়, ‘এটা স্বামীর মাথা ধরে থাকা অভিজিৎ রায়ের রক্তাক্ত স্ত্রী। শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। গত তিন থেকে চার বছর ধরে সে শীর্ষ টার্গেটে ছিল।’ আরেকটি পোস্টে বলা হয়েছে, ‘আমেরিকা আমাদের দুজন ভাই খুরসাম আর শামকে শহীদ করেছে। এর প্রতিশোধ নেওয়া হলো।’
এর আগে ফেসবুকে ফারাবী সাইফুর রহমান নামের একটি অ্যাকাউন্টে ৯ ফেব্রুয়ারির একটি স্ট্যাটাসে লেখা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকা থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হামলার ধরন এবং এর আগে-পরে ফেসবুক ও টুইটারে উগ্রপন্থীদের কিছু প্রচারণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ব্লগার রাজীব হায়দারের মতো এই হত্যার ঘটনায়ও উগ্রপন্থী কোনো গোষ্ঠী জড়িত।
ব্লগারদের ওপর হামলার প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি। সেদিন রাত সাড়ে ১০টার দিকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে হামলার শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। হামলাকারীরা পেছন থেকে তাঁর ঘাড়ে ও পিঠে কুপিয়ে ফেলে যায়। মারাত্মক আহত হলেও তিনি বেঁচে যান।
এর এক মাস পর আরেক ব্লগার রাজীব হায়দারকে রাজধানীর পল্লবীতে একই কায়দায় চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে রাজীব হত্যায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন জড়িত। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন বিচারাধীন।
রাজীব হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, ব্লগার আসিফের ওপর হামলায়ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জড়িত ছিল।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাকাউন্ট থেকে স্ট্যাটাস দিয়ে দায় স্বীকার করা হয়। ওই দিন রাত আটটার দিকে ফেসবুকের ওই গ্রুপটি খোলা হয়। তাতে বলা হয়, ‘আমাদের মুজাহিদীনরা আজকে রাজশাহীতে এক মুরতাদকে কতল করেছেন, যে তার ডিপার্টমেন্টে ও ক্লাসে বোরকা পরা নিষিদ্ধ করেছিল।’ ওই ওয়েবপেজে বলা হয়, রাজীব হায়দার ও আশরাফুল আলমের ধারাবাহিকতায় শফিউল ইসলামকে খুন করা হয়েছে।
অধ্যাপক শফিউল হত্যা মামলাটি এখন রাজশাহী মহানগর ডিবি তদন্ত করছে। তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে রাজশাহী মহানগর ডিবির সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইফতেখায়ের প্রথম আলোকে বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে।’ অবশ্য এর আগে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র্যা বের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করা হয়েছিল, নারীঘটিত ঘটনায় শফিউল ইসলামকে হত্যা করেন স্থানীয় এক বিএনপি নেতা।
অধ্যাপক শফিউল হত্যার ঘটনার পর দায় স্বীকার করা ফেসবুক পেজে আশরাফুল আলম নামে একজনকে হত্যারও দায় স্বীকার করা হয়। এর দেড় মাস আগে ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ছাত্র আশরাফুল আলমকে তাঁর বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ এখনো এ খুনের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। সাভার সার্কেলের সহাকারী পুলিশ সুপার রাসেল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত চলছে।
১১ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে একইভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করা হয় বহুমাত্রিক লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্যরা ওই হামলা করেছিল।
এসব হামলার ধরন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, বাইরে থেকে সব ঘটনা একই রকম মনে হলেও আসলে প্রতিটি ঘটনার ভিন্ন রকম পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। ভিন্ন রকম গোষ্ঠী আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কাজ করছি, সময় ধরে বলা যাবে না। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব এর পেছনে যারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে।’