এক উপজেলাতেই ২১ সন্ত্রাসী বাহিনী

অপরাধ
প্রতীকী ছবি

কেউ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন পাড়া-মহল্লায়। কেউ গোটা ইউনিয়ন। কেউবা আশপাশের ইউনিয়নেও ত্রাসের সৃষ্টি করে আসছেন। অঞ্চলভিত্তিক দাপিয়ে বেড়ানো ছোট-বড় ২১টি বাহিনীর কাছে অনেকটা জিম্মি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দারা। সব ক্ষেত্রে দলীয় পদ–পদবি না থাকলেও এসব বাহিনীর প্রধানেরা কোনো না–কোনো রাজনৈতিক দলের নাম-পরিচয় ব্যবহার করেই অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা এসব বাহিনীর মধ্যে ১৫টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। বাকি ৬টি বাহিনী বিএনপির সঙ্গে যুক্ত। বেগমগঞ্জ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় এসব বাহিনী সক্রিয় রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বিগত বিএনপি সরকার আমলেও এলাকাভিত্তিক কিছু কিছু সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল। গত ১০ বছরে নতুন নতুন বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছে। এরা মূলত সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ হিসেবেই পরিচিত।

সম্প্রতি বেগমগঞ্জের একলাশপুরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও চিত্র প্রকাশ পাওয়ার পর সারা দেশে জানাজানি হয় সেখানকার দেলোয়ার বাহিনীর কথা। দেলোয়ার গ্রেপ্তার হওয়ার পর জানা গেল, এই বাহিনীর কথা রাজনৈতিক দল, পুলিশ সবাই জানত। অস্ত্রসহ জনতা ধরিয়ে দেওয়ার পরও ছাড়া পেয়েছিলেন।

দেলোয়ার ধরা পড়ার পর এখন খবর বের হচ্ছে আরও কত বাহিনী আছে ওই এলাকায়। স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচন, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা বা এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে কোনো না–কোনো রাজনীতিক এসব বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন বলে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। এখন পরিস্থিতির চাপে কোনো দল বা নেতা এসব বাহিনীর দায় নিচ্ছেন না। যদিও বিভিন্ন বাহিনীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও।

স্থানীয় সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীর কোনো দল নেই। এসব সন্ত্রাসীর দলীয় কোনো পদ–পদবি নেই। দলের কেউ তাদের প্রশ্রয় দেয় কি না, তাও তিনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘সুমন বাহিনী, সম্রাট বাহিনী, দেলোয়ার ও টিটু বাহিনীসহ যেসব বাহিনীর কথা এখন আলোচিত হচ্ছে, এসব বাহিনীর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও মাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে অনেকবার বলেছি। প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেকে বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে।’

বেগমগঞ্জের কোন এলাকায় কত সন্ত্রাসী বাহিনী আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধান ও সরকারি একাধিক সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ২১টি বাহিনীর নাম পাওয়া গেছে। তবে বেগমগঞ্জ মডেল থানা থেকে সম্প্রতি প্রত্যাহৃত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ হারুন অর রশিদ চৌধুরী দাবি করেন, তিনি যে ১৬ মাস ওসির দায়িত্বে ছিলেন, তখন কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর নাম শোনেননি।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, খুনখারাবি ও মামলা-মোকদ্দমার দিক দিয়ে চৌমুহনী পৌর এলাকার সম্রাট বাহিনী ও সুমন বাহিনী সবচেয়ে আলোচিত। দুই বাহিনীরই সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এরপর আলোচিত জাহাঙ্গীর বাহিনী ও জুয়েল বাহিনী। সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হিসেবে পরিচিত এই দুই বাহিনীর দাপট রয়েছে রাজগঞ্জ, ছয়ানী, একলাশপুর ও শরীফপুর ইউনিয়নে।

নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দলীয়ভাবে কখনোই কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর দলের কোনো কোনো নেতা বা জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন বা প্রশ্রয় দেন বলে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ এই নেতা বলেন, ‘কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু কিছু বিষয়ে সব সময় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।’

কোথায় কোন বাহিনীর দাপট

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলার সবচেয়ে সন্ত্রাস ও সহিংসতাকবলিত এলাকা পশ্চিমাঞ্চলের চার ইউনিয়ন হলো আমানউল্যাহপুর, আলাইয়াপুর, গোপালপুর, জিরতলী।

এর মধ্যে আলাইয়াপুর ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপির টিটু বাহিনী। বাহিনীর প্রধান মো. হানিফ ওরফে টিটুর বিরুদ্ধে ১০-১২টি মামলা রয়েছে। একই এলাকায় দাপট রয়েছে মোহন বাহিনীর। বাহিনীর প্রধান মো. মোহনের বিরুদ্ধে চারটি অস্ত্র মামলাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। একসময় এই এলাকায় দাপট ছিল বাশার বাহিনীর। ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন মোহনের মামা আবুল বাশার ওরফে বাশার মেম্বার। বেশ কয়েক বছর আগে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বাশার নিহত হন। এরপর মোহন এই বাহিনীর হাল ধরেন। এই ইউনিয়নে তৎপর আছে সরকারি দলের সাহাব উদ্দিন, আবদুর রহিম ওরফে মাছ রহিম এবং বিএনপির মো. কবির ওরফে ছাল্লি কবির।

আলাইয়াপুর ইউনিয়নের সাবেক ও বর্তমান একাধিক জনপ্রতিনিধি প্রথম আলোকে বলেন, এই ইউনিয়নে দুটি বাহিনী বেশি আলোচিত। এর মধ্যে একটি বাহিনীর প্রধান আলাউদ্দিন কয়েক মাস ধরে কারাগারে। টিটু কয়েক মাস ধরে এলাকায় নেই। এর বাইরে মনা বাহিনী ও বাবু বাহিনীর কথাও শোনা যায়।

এখানকার ইউপি চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধেও কোনো কোনো বাহিনীকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ওপর মনা বাহিনী দুবার হামলা চালিয়েছে; কিন্তু বিচার পাননি। উল্টো হামলাকারীদের এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন দলের প্রভাবশালীরা।

পাশের গোপালপুর ইউনিয়নে সক্রিয় রয়েছে মাছুম বাহিনী। জিরতলী, রাজগঞ্জ ও ছয়ানীতেও আছে ছোটখাটো বিভিন্ন বাহিনী। এসব বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ শোনা যায়।

আমানউল্যাহপুরে সক্রিয় আছে ছয়টি বাহিনী। এর মধ্যে তিনটি মামুন ওরফে ধোপা মামুন, পিয়াস ও নাইমুল বাহিনী আওয়ামী লীগের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। অপর তিনটি বাহিনী সবুজ, বিষু ও পারভেজ মিজান বাহিনী বিএনপির অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

নোয়াখালী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে সে ক্ষেত্রে দল অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে বিএনপি নামধারী কেউ আওয়ামী লীগের নেতাদের প্রশ্রয়ে থেকে যদি কোনো অপকর্ম করে, তার দায় বিএনপি নেবে না।

স্থানীয় লোকজন জানান, দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন একসময় চৌমুহনীর পৌরসভার হাজীপুর এলাকার সন্ত্রাসী সুমন বাহিনীর সদস্য ছিলেন। বছর দুয়েক আগে দেলোয়ার নিজেই বাহিনী গড়ে তোলেন। সরকারি দলের কারও কারও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় তখন চৌমুহনীতে অস্ত্র-গুলিসহ হাতেনাতে জনতার হাতে ধরা পড়ার পরও কারাগারে যেতে হয়নি। একলাশপুরের জোড়া খুনের মামলায় অভিযুক্ত এবং তাঁর বাড়ি থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের ঘটনায়ও বেঁচে যান তিনি। সর্বশেষ নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে দুটি থানায় মামলা হয়েছে।

একলাশপুরের পার্শ্ববর্তী শরীফপুর ইউনিয়নে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সুজন বাহিনী। মীরওয়ারিশপুর ইউনিয়নে সক্রিয় পার্শ্ববর্তী সোনাইমুড়ী উপজেলার হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজির মামলার আসামি জাকির হোসেন। নোয়াখালীর একটি আদালতে সম্প্রতি অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের সাজা হলেও জাকিরকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

তবে নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বেগমগঞ্জে বাহিনী বলতে দুটি; সম্রাট ও সুমন বাহিনী। এই দুটি বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা রয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, আবার জামিনে বের হয়ে গেছেন। সম্প্রতি অন্য যেসব বাহিনীর কথা আলোচিত হচ্ছে, সেগুলো আসলে বড় কোনো বাহিনী নয়। এরপরও এসব বাহিনীর বিষয়ে পুলিশি পদক্ষেপ অব্যাহত আছে।

বিএনপি থেকে আ.লীগে দুর্ধর্ষ দুই বাহিনী

সম্রাট বাহিনী ও সুমন বাহিনীর প্রধান একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা নিজেদের যুবদল পরিচয় দিতেন। দুজনেরই বাড়ি উপজেলার হাজীপুর এলাকায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুজনই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন। দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও সম্রাট ও সুমন এলাকায় যুবলীগের নেতা হিসেবেই পরিচিত। স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির প্রশ্রয়ে তাঁদের দাপট বেড়েছে বলে এলাকাবাসী ও দলীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে। একই দলের হলেও আধিপত্য বিস্তার ও অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। দুই বাহিনীর সদস্যরা চৌমুহনী পৌর এলাকা ও হাজীপুরের আশপাশের একাধিক ইউনিয়নে সক্রিয়।

বেগমগঞ্জ থানায় সদ্য যোগ দেওয়া ওসি কামরুজ্জামান সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, সম্রাটের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের ১৩টি মামলা রয়েছে। প্রায় সমানসংখ্যক মামলা রয়েছে সুমনের বিরুদ্ধেও। সম্রাটকে কিছুদিন ধরে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। আর সুমনকে গত বছরের মে মাসে ডিবি একবার গ্রেপ্তার করেছিল। কয়েক মাস পর জামিনে মুক্তি পান। এরপর আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ শোনা গেছে।

একসময়ের শান্ত জনপদ বেগমগঞ্জ উপজেলার এই অবস্থার জন্য দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দায়ী বলে মনে করছেন এলাকাবাসী ও নাগরিক সমাজ। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নোয়াখালী জেলা কমিটির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোল্লা হাবিবুর রাছুল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো রাজনীতিক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে। স্বভাবতই ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়ে বেশি থাকে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসীরা দলের কেউ নয়, এ কথা বলে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন দায় এড়ানোর সুযোগ নেই, আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ছোট ছোট বাহিনীকে প্রশাসন চাইলে সহজে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। এসব সন্ত্রাসী যখন বড় বাহিনীতে পরিণত হবে, তখন নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।