তুরাগ ও বুড়িগঙ্গা নদীর জায়গায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্ছেদে অভিযান চালাতে প্রায় এক মাস আগে চিঠি দিয়েছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসরণ না করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও ঢাকা জেলা প্রশাসন উল্টো এ বিষয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে চিঠি দিয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে তোলা ওই দুটি স্থাপনার মালিক ঢাকা-১৪ আসনের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংসদ আসলামুল হক।
গত ১২ জানুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আমিনুর রহমানের সই করা চিঠিটি বিআইডব্লিউটিএ এবং ঢাকার জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পত্রের আলোকে জেলা প্রশাসক, ঢাকার সাথে সমন্বয় করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য (অতিরিক্ত সচিব) মো. আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদের পরিকল্পনা বিআইডব্লিউটিএ–কেই নিতে হবে। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ নদী রক্ষা কমিশনের নেই।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু (বছিলা সেতু নামে পরিচিত) পার হলেই ডান পাশে নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে তোলা হয়েছে ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ ও ‘মায়িশা গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট’। তুরাগ ও বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থলের পাশেই এই দুটি স্থাপনা। দুটি স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে গত বছরের মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে বাধা দেন সাংসদ আসলাম। পরে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হন এবং একই সঙ্গে তাঁর দখলে থাকা জমি বুড়িগঙ্গা বা তুরাগের সীমানার মধ্যে পড়েছে কি না, তা নির্ধারণ করতে যৌথ জরিপ পরিচালনার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে আবেদন করেন।
আদালতের নির্দেশ এবং সাংসদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি, জরিপ ও পরিদর্শন শেষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নিশ্চিত হয়, ওই সব স্থাপনা অবৈধ। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংসদ আসলাম আবেদনে দাবি করেছিলেন, তাঁর ওই স্থাপনা ৫১ একরের কিছু বেশি জায়গাজুড়ে রয়েছে। কিন্তু জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, জমির পরিমাণ ৫৪ একরের কিছু বেশি। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীর এবং বন্দরের সীমার জমি প্রায় ৮ একর, নদীর জমি প্রায় ১৩ একর। বাকি জমি ড্যাপের আওতাভুক্ত।
উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদের ৫৪ একরের মধ্যে শুধু ৮ একর পড়েছে বিআইডব্লিউটিএর আওতার মধ্যে। সেখানে তারা যেকোনো দিন গিয়ে সীমানা পিলার বসিয়ে আসতে পারেন। আর মূল স্থাপনা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও রাজউকের আওতায় পড়েছে। সেগুলো কারা উচ্ছেদ করবে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা নেই।
উচ্ছেদের চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল মূলত বিআইডব্লিউটিএ–কে। বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বলছেন, এই উচ্ছেদ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনার জন্য তিনি নদী কমিশনকে চিঠি পাঠিয়েছেন। এখন নদী কমিশন বা বিআইডব্লিউটিএ পরিকল্পনা নিলে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদে সব ধরনের সহায়তা করবে।মো. শহীদুল ইসলাম , ঢাকা জেলা প্রশাসক
বিআইডব্লিউটিএর একজন কর্মকর্তা বলেন, সাংসদ আসলাম তাঁর দখল করা জায়গায় উচ্ছেদে স্থগিতাদেশ চেয়ে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে ৯টি মামলা করেছেন। এর মধ্যে চারটি মামলার রায়ই বিআইডব্লিউটিএর পক্ষে এসেছে। মামলায় তিনি হেরে গেলেই বলেন বিষয়টা মানেন না। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও তাঁরা চিঠি দিয়েছেন।
ঢাকা জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উচ্ছেদের চিঠিটি পাঠানো হয়েছিল মূলত বিআইডব্লিউটিএ–কে। বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান বলছেন, এই উচ্ছেদ একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এ জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই পরিকল্পনার জন্য তিনি নদী কমিশনকে চিঠি পাঠিয়েছেন। এখন নদী কমিশন বা বিআইডব্লিউটিএ পরিকল্পনা নিলে জেলা প্রশাসন উচ্ছেদে সব ধরনের সহায়তা করবে।
সাংসদ আসলামের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর যে সদিচ্ছা নেই, তারই চিত্র এটি। এই উচ্ছেদে কোনো ধরনের আইনি বাধা নেই। প্রতিটি পক্ষ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে যেকোনো সময় উচ্ছেদ করতে পারে।মনজিল মোরসেদ , সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
নদী রক্ষা কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আইন অনুযায়ী নদীর জমির মালিক জনগণ এবং রাষ্ট্র। কোনো অবস্থাতেই নদীর জায়গা ব্যক্তিমালিকানায় লিজ, বিক্রি বা অধিগ্রহণ করা যাবে না। সাংসদ আসলামের অবৈধ দখল ও স্থাপনা নির্মাণে সরকারি সংস্থার গাফিলতি ছিল বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল।
মন্ত্রণালয় চিঠি দেওয়ার পরও অভিযান চালাতে গড়িমসির বিষয়ে নদী রক্ষা আন্দোলনে যুক্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, সাংসদ আসলামের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর যে সদিচ্ছা নেই, তারই চিত্র এটি। এই উচ্ছেদে কোনো ধরনের আইনি বাধা নেই। প্রতিটি পক্ষ নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে যেকোনো সময় উচ্ছেদ করতে পারে।