আড়ি পাতার যন্ত্র ও অস্ত্র চায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর
এবার মুঠোফোনে আড়ি পাতার যন্ত্র চাইছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে তারা অস্ত্র, গোলাবারুদও চায়। যদিও এসব ব্যবহারের কোনো প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা তাদের নেই। নেই অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণের মতো প্রয়োজনীয় কাঠামোও।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক বাহিনী ও সংস্থার কাছে টেলিফোনে আড়ি পাতার যন্ত্র আছে। জঙ্গি দমনসহ রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত নানা কাজে আড়ি পাতা যন্ত্র ব্যবহারের কথা বিভিন্ন অভিযানের পর জানানোও হয়। তবে এ ধরনের যন্ত্রের উদ্দেশ্যপূর্ণ ও যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ থাকায় বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন এর বিরোধিতা করে আসছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, মাদক চোরাকারবারি এবং এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজখবর করা ও তাঁদের অবস্থান জানার জন্য এ আড়ি পাতা যন্ত্র তাদের দরকার। আর বর্তমানে খালি হাতে গিয়ে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অন্য বাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় তাদের।
জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির প্রথম সভা গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে শীর্ষস্থানীয় এ কমিটির সামনে নিজেদের প্রস্তাব তুলে ধরে অধিদপ্তর। অস্ত্র দেওয়ার ব্যাপারে কমিটির সদস্যরা ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও টেলিফোনে আড়ি পাতার যন্ত্রের বিষয়টি শুরুতেই নাকচ করে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি এ কমিটির সভাপতি।
বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মুঠোফোন ট্র্যাকিং একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ মুহূর্তে মুঠোফোন ট্র্যাকার ক্রয় করা সমীচীন হবে না। তিনি মাদক চোরাকারবারিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও গ্রেপ্তারের জন্য ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিবের লিখিত আদেশ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এনটিএমসিতে যেতে পারবেন।
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহসানুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি আবারও বিষয়টি বিবেচনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন। দেশজুড়ে মুঠোফোন ট্র্যাক করার মতো প্রযুক্তি তাঁরা এখনই চাইছেন না। অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস হলেও তাঁদের চলবে।
‘এখন কী করে কাজ চলছে’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত তাঁরা এনটিএমসির কাছ থেকে তথ্য সহযোগিতা নিয়ে কাজ করেন। মাসখানেকের মধ্যে এনটিএমসিতে তাঁদের একজন কর্মকর্তা নিয়মিত বসবেন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি সংস্থা ডিনেট ও আইসোশ্যালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অনন্য রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যদি কোনো ব্যক্তির কথোপকথন রেকর্ড করতে হয়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতের অনুমতি নেওয়া উচিত। আর এ ক্ষমতা যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা ভালো। তা না হলে নাগরিকদের নিরাপত্তার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
উপদেষ্টা কমিটির সভায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, তাদের কর্মীরা গত ১০ বছরে ১৩টি রিভলবার, ৫৭টি পিস্তল, একটি শটগান, একটি পাইপগান, ৪টি এয়ারগান, ২৫টি ম্যাগাজিন ও ৬৪৬টি গুলি উদ্ধার করেছেন। মাদক পাচারকারীরা প্রায়ই অধিদপ্তরের নিরস্ত্র কর্মীদের ওপর আক্রমণ চালান। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তাই সরাসরি যাঁরা মাঠে কাজ করছেন, তাঁদের অস্ত্র দেওয়া দরকার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ছাড়া সভায় উপস্থিত বাকি পাঁচজন মন্ত্রী, দুজন সচিব, দুজন চিকিৎসক ও একজন সাংবাদিক অধিদপ্তরের কর্মীদের অস্ত্র দেওয়ার পক্ষে মত দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে অস্ত্রধারী অনেক বাহিনী আছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে আরেকটি অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর প্রয়োজন আছে কি না, তা ভাবতে হবে। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোয় এ ধরনের বাহিনী ও সংস্থার সদস্যদের হাতে অস্ত্র থাকে কি না, সে ব্যাপারেও খোঁজখবর নেওয়ার পরামর্শ দেন। আর সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কী ধরনের অস্ত্র দরকার, কীভাবে দেওয়া যায়, কোন পর্যায় পর্যন্ত কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে, এ বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করতে হবে।
বৈঠকের পর তিন মাস পার হলেও অধিদপ্তর এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহসানুল জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে চাওয়ার সুযোগ দিলে তো আমি কামান চাইব। আপাতত উপপরিদর্শক, পরিদর্শক ও সহকারী পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ছোট অস্ত্র দিয়ে শুরু করা যায়।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, একটা নিরস্ত্র বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তর করার কাজটা সময়সাপেক্ষ। কারা, কোন ধরনের অস্ত্র পাবেন, অস্ত্র কোথায়, কীভাবে রাখবেন, তা নিয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনার ব্যাপার আছে।
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানান, মাদক নিয়ন্ত্রণে ভারতের প্রধান সংস্থা নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরো (এনসিবি) সশস্ত্র সংস্থা নয়। তারা মূলত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগকারী রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সংস্থাগুলোর সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে পুলিশ, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কোস্টগার্ড, গোয়েন্দা সংস্থা, শুল্ক ও বন বিভাগ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অস্ত্র চাওয়ার বিষয়টি কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার একটা আলাদা ব্যবস্থাপনার বিষয়। অস্ত্র রাখার জন্য অস্ত্রাগার প্রয়োজন, সেটা আবার পাহারা দিতে হয়। কে কোন অস্ত্র থেকে কতটি গুলি ব্যবহার করছে এবং অস্ত্রের অপব্যবহার হচ্ছে কি না, সেটার হিসাব রাখতে হয়। একটা দীর্ঘ প্রস্তুতির ব্যাপার। তিনি বলেন, মাদক উদ্ধার অভিযান একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। যে বাহিনীগুলো মাদক উদ্ধারের কাজ করছে, সেগুলোর উচিত অভিযানে যাওয়ার সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে তাৎক্ষণিক সহযোগিতা দেওয়া।