আকাশপথে নিরাপদে ইয়াবা পাচার
নজরুল ইসলাম (৪৬) ও মোহাম্মদ জুবায়ের (২২) মিয়ানমারের আরাকানের বাসিন্দা। বহু বছর আগে বাংলাদেশে এসে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় বসবাস করতেন এই দুই রোহিঙ্গা। দুজনই এ দেশে চাকরি করতেন একটি ওষুধ কোম্পানিতে। ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করার সময় ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গত ১২ জুন আকাশপথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল এলাকা থেকে নয় হাজার ইয়াবাসহ এঁদের আটক করা হয়। দেশের সর্ববৃহৎ বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায়ই ইয়াবার চালান জব্দের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। গত এক বছরে শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে সোয়া লাখের বেশি ইয়াবা জব্দ করেছে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এসব ইয়াবা পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে হাতেনাতে আটক ৬০ জন। একইভাবে ঢাকায় পাচারের সময় কক্সবাজার বিমানবন্দরে গত আড়াই বছরে ৪০ জনের কাছ থেকে ৬০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের দুটি বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার হয়েছে পৌনে দুই লাখ ইয়াবা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সড়কপথের তল্লাশি এড়াতে, সময় বাঁচাতে নতুন কৌশল হিসেবে ইয়াবা পাচারের জন্য আকাশপথকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
আকাশপথে পাচারের যত কৌশল
কোমরে বেল্ট বেঁধে, প্যান্টের পকেটে, প্যাকেট করে গিলে পেটের মধ্যে করে ইয়াবা আকাশপথে পাচার করা হয়। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও প্যাকেট গিলে ইয়াবা পাচার বেশি হয়ে থাকে। এ ছাড়া আকাশপথে ইয়াবা পাচারকারীদের একটি বড় অংশ হলো নারীরা। নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে ছোট ছোট প্যাকেট করে ইয়াবা পাচার করে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আনা হয়।
পেটে নিরাপদে পাচার
২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ মাসে ২৬টি ঘটনায় শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা থেকে ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৪৪টি ইয়াবা উদ্ধার করে এপিবিএন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সংস্থা দুটির এসব যৌথ অভিযানে ৬০ জনকে ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের মধ্যে ১২ জন বিশেষ কৌশলে পেটের ভেতর করে ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসেন। এই ১২ জনের পেটের ভেতর থেকে ৩২ হাজার ৫১০টি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। ইয়াবা পাচারের ২৬টি ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ৪৮টি মামলা হয়েছে।
>
- ঢাকা ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে জব্দ পৌনে দুই লাখ ইয়াবা
- পাচারকারীর পেটে থেকে উদ্ধার এক লাখ ইয়াবা
অন্যদিকে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে ঢাকায় পাচারের সময় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত আড়াই বছরের বেশি সময়ে ৬০ হাজার ৮৩০টি ইয়াবাসহ ৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তার ৪১ জনের মধ্যে অর্ধেক পাচারকারী পেটে ইয়াবা বহন করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বিমানবন্দর এপিবিএনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর অধিকাংশ পাচারকারী নিজেদের বাহক হিসেবে দাবি করেন।
পেটের ভেতরে ইয়াবা পাচারের কারণ সম্পর্কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, পেটে করে ইয়াবা পাচারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৫০টির মতো ইয়াবা স্কচটেপে জড়িয়ে জলপাই বা জামের আকৃতিতে প্যাকেট করা হয়। এ রকম ইয়াবাভর্তি ৩০ থেকে ৪০টি প্যাকেট কলা দিয়ে গিলে পাকস্থলীতে ঢোকানো হয়। পরে ঢাকায় পৌঁছে পায়ুপথ দিয়ে ইয়াবার প্যাকেটগুলো বের করে দেন পাচারকারীরা।
তবে ধরা পড়ার পর পেট থেকে ইয়াবা বের করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন অভিযানকারী কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, শনাক্ত করার পর পাচারকারীকে এক্স-রে করা হয়। প্রচুর পরিমাণে পানীয় বা স্যালাইন পান করানো হয় ইয়াবা পাচারকারীকে। তাঁর পেট থেকে ইয়াবা বের করে আনতে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সময় চলে যায়। কোনো কোনো পাচারকারীর পেট থেকে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এই ইয়াবা পেটের ভেতরে বের হলে পাচারকারী সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবেন।
নারীদের ব্যবহার
গত ২৫ জানুয়ারি নভোএয়ারের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসেন ইশা নামের এক নারী। গোপন সংবাদ পেয়ে শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এপিবিএন সদস্যরা। একপর্যায়ে ইশা তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ থেকে ৭২০টি ইয়াবা বের করে দেন।
নারীদের ব্যবহার করে আকাশপথে ইয়াবার চালান ঢাকায় আনা হয়। আড়াই বছরে ঢাকা ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে ১৪ জন নারী যাত্রীকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নারীদের দিকে নজরদারি কম থাকে। তাই ইয়াবা পাচারকারী চক্র নারীদের ব্যবহার করে থাকে। নারীদের শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে সহজে ইয়াবা বহন করা যায়। এ ছাড়া অনেক নারী পাচারকারী তাঁদের সঙ্গে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগ, কোমর, শাড়ির ভাঁজে ইয়াবা বহন করেন।
এ ছাড়া সম্প্রতি বিশেষ ধরনের বেল্টে করে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে বলে জানান বিমানবন্দর এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে অনেক নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে ইয়াবা বহন করানো হয়। তা ছাড়া ইয়াবা পাচারে বিশেষ ধরনের বেল্ট ব্যবহার করা হয়। অর্থোপেডিক রোগীরা কোমরে যে বেল্ট ব্যবহার করেন, ইয়াবা পাচারকারীরা সেই ধরনের বেল্টে ব্যবহার করছেন। গত ১৮ আগস্ট ১০ হাজার ইয়াবা এভাবে বেল্টে লুকিয়ে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসে ধরা পড়েন জসিম উদ্দিন নামের এক যাত্রী।
কেন এই ঝুঁকি?
বেশি লাভ এবং নিরাপদে পাচারের জন্যই পেটের ভেতরে করে ইয়ারা বহনের ঘটনা বেশি ঘটছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সাল থেকে আকাশপথে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা পাচারের ঘটনা বেশি ঘটতে থাকে। কক্সবাজার বিমানবন্দরে ওই বছর বিভিন্ন সময় ১২ জন বিমানযাত্রীকে ১৭ হাজার ৬০০ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ১২ জনের মধ্যে পাঁচজন নারী ছিলেন। ২০১৮ সালে কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের কারণে আকাশপথে ইয়াবা পাচার আরও বেড়ে যায়। এই বছর ২৮ জনকে ইয়াবা পাচারের অভিযোগ কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের কাছে পাওয়া যায় ৩৯ হাজার ৯০টি ইয়াবা। তবে চলতি বছরের আট মাসে কক্সবাজার বিমানবন্দরে ইয়াবা পাচারের অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই পাচারকারীর কাছে ৪ হাজার ৬৮০টি ইয়াবা পাওয়া যায়।
কক্সবাজারে কমেছে, ঢাকায় বেড়েছে
কক্সবাজার বিমানবন্দরে ইয়াবা জব্দের ঘটনা কমলেও ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চিত্র ঠিক উল্টো। চলতি বছর কক্সবাজার বিমানবন্দরে ইয়াবা পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হলেও ঢাকার বিমানবন্দর থানায় এই সংখ্যা ছিল ২৬। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩০ জন। আর ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৭১ হাজার ৮০১টি।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, কক্সবাজার বিমানবন্দরে নজরদারির অভাবে সহজেই আকাশপথে ইয়াবার চালান পাচার হয়ে ঢাকায় আসছে। তা ছাড়া কারও পেটের ভেতরে পাচার করা হলে ইয়াবা শনাক্ত করা করা যায় না।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিভিল এভিয়েশন) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়াবার প্যাকেট গিলে পাচার করা হয়। এভাবে ইয়াবা আনা হলে পাচারকারীকে শনাক্ত করা যায় না। স্ক্যানার মেশিনে ধরা পড়ে না। তবে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই তো পাচারকারীরা বিমানবন্দরে ধরা পড়ছে। ছয়টি নতুন স্ক্যানার জাইকার কাছ থেকে আমরা খুব শিগগির পাব। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এগুলো পেয়ে যাব। অত্যাধুনিক এসব স্ক্যানার দিয়ে বডি স্ক্যান করা যাবে। এতে করে ইয়াবা যেভাবেই আনা হোক না কেন, পাচারকারীকে ধরা সম্ভব হবে।’
ঢিলেঢালা তদন্ত
চলতি বছরের ১২ জুন ৯ হাজার ইয়াবাসহ নজরুল ইসলাম (৪৬) ও মোহাম্মদ জুবায়ের (২২) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে বিমানবন্দর এপিবিএন। এঁদের পেটের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় এসব ইয়াবা। পরদিন ১৩ জুন বিমানবন্দর নজরুল ও জুবায়েরকে আসামি করে মামলা হয়। এ ঘটনার এপিবিএনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নজরুল ও জুবায়ের দুজনই রোহিঙ্গা।
তবে এরপর প্রায় তিন মাস পেরিয়ে গেলেও দুই আসামির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কবীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দুই আসামির মধ্যে জুবায়ের জাতিতে একজন রোহিঙ্গা। কয়েক বছর আগে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসেছেন। তবে নজরুল ইসলামের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাঁর তদন্ত চলছে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। এগুলো সম্পন্ন হলে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।
অন্যান্য মামলার তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবা পাচারের ঘটনায় সম্প্রতি যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর তদন্ত চলছে। তবে গত বছর থেকে ইয়াবা পাচারের অন্য যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলোর চূড়ান্ত প্রতিবেদন খুব শিগগির আদালতে জমা দেওয়া হবে।
কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে ইয়াবাসহ মাদক পাচার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ইয়াবা পাচারকারীদের নজরদারির মধ্যে রেখেছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাচারকারীরা ধরা পড়ছে। ইয়াবা স্থানান্তর করাটা অত্যন্ত লাভজনক। তাই যেভাবে বা যেপথে সুযোগ পাওয়া যায়, পাচারকারীরা সেই পথই ইয়াবা বহনের জন্য বেছে নেয়। পাচার ঠেকাতে বা নজরদারি বৃদ্ধি করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’
মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে নতুন একটি জনবলকাঠামো পাওয়া গেছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দরে আমাদের একটি ইউনিট কাজ করবে। এই ইউনিটে সদস্যসংখ্যা হবে ছয় বা সাতজন।’