অভিযানের মধ্যেও মাদক বেচাকেনা
>
- ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩০০ নিহত, ৬০ হাজার গ্রেপ্তার।
- তারপরও মাদক দ্রুত নির্মূল হবে এমন আশা নেই।
- মাদক নির্মূলে সব মহল আন্তরিক নয়।
- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
- গডফাদারদের অর্থবিত্তের উৎস সন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেই।
ধারাবাহিক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও অভিযানের মধ্যেই ইয়াবার কেনাবেচা চলছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রায় ৩০০ নিহত এবং ৬০ হাজার ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলেও মাদক দ্রুত নির্মূল হবে এমন আশা নেই। মাদকবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত সূত্রগুলো বলছে, ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ ঘোষণা হলেও সব মহল আন্তরিক ছিল না। তাই ফলও হতাশাজনক।
বিশেষ অভিযানেও সাফল্য নেই কেন, এ নিয়ে কথা বলেছেন তিনটি বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা। পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তারা বলেন, প্রথমত, বিশেষ অভিযান বিরতিহীনভাবে চলতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সব বাহিনীর একযোগে কাজ করা এবং কাজের মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল। সেটা হয়নি। দ্বিতীয়ত, গডফাদারদের প্রায় শতভাগকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে গডফাদারদের জিম্মায় ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে না বা তাঁরা সরাসরি ইয়াবা ব্যবসা করছেন এমনটাও প্রমাণ করা যাচ্ছে না। অথচ তাঁদের প্রত্যেকের অর্থ-বিত্তের উৎস খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। তৃতীয়ত, পুলিশ এখন নির্বাচনী ট্রেনে। কোনো অবস্থাতেই ‘মাদক নির্মূল’ এখন তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, স্থল ও নৌসীমান্ত দিয়ে মাদকের প্রবেশ ঠেকানো যায়নি। আর প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাদক আনা-নেওয়ার কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা। তালিকাভুক্ত গডফাদারদের মধ্যে মাত্র একজন কারাগারে ও দুজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।
তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামালউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিযানের সফলতা হলো, গডফাদারদের কেউ স্বস্তিতে নেই। প্রায় সবাই এলাকাছাড়া। ক্ষুদ্র মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ করে গডফাদারদের সটকে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে যে অভিযোগ, সেটা সত্য নয়।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ১৪ অক্টোবর সাংবাদিকদের বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে, আরও বেগবান হবে।
ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যায়নি
মাদক নির্মূলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের নেতৃত্বে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড, র্যাব-পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। মূল কার্যক্রমের মধ্যে এক নম্বরে ছিল সীমান্ত পথে মাদকদ্রব্যের অবৈধ প্রবেশ বা পাচার বন্ধ করা। আর দুই নম্বরে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্ত পথে মাদকের প্রবেশ বন্ধ হয়নি। স্থলপথ ও জলপথ—দুদিক থেকেই ইয়াবা আসছে।
বিজিবির হিসাবে গত বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ লাখ ৩৯ হাজার ৯৪৮ টির বেশি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার হয়েছে। সীমানা পেরিয়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে পুলিশ ও র্যাবের উদ্ধারও গেল বছরের তুলনায় বেশি। এ বছরের মে-আগস্ট পর্যন্ত ১ কোটি ৩১ লাখ ১১ হাজার ৮০৬টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে তারা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, মাদকের প্রবেশ ঠেকানো গেলে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইয়াবা ধরা পড়ত না।
মাদকবিরোধী অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী একটি বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার-মিয়ানমার সীমান্তের ৬৪টি স্থান দিয়ে ইয়াবা আসে। আর আসে বিভিন্ন নৌযানে করে। সিদ্ধান্ত ছিল, এগুলো দিয়ে ইয়াবার প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হবে। আর জলপথে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটি ছোট বন্দরের মতো করা হবে, সেখানে নৌযানগুলোকে রিপোর্ট করতে হবে। কাজগুলোর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
তা ছাড়া বিজিবি ও কোস্টগার্ড প্রচুর পরিমাণে ইয়াবা ধরলেও গ্রেপ্তার কম। কোস্টগার্ডের মুখপাত্র লে. কমান্ডার আবদুল্লাহ আল মারুফ জানান, মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই বাহিনী প্রায় ২১ লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার এবং ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আলাদাভাবে কতটি অভিযানে কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই পরিসংখ্যান তিনি দিতে পারেননি। তবে এই সময়ে নয়টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কোস্টগার্ড একজনের গ্রেপ্তার কথা জানিয়েছে। বাকিরা কখনো জঙ্গলে, কখনো মিয়ানমার সীমান্তের দিকে চলে গেছে বলে জানায় তারা।
গডফাদাররাও আরামে
পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ১ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে গডফাদারদের তালিকা তৈরির সময় বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল মদদদাতা, সাহায্যকারী ও অর্থলগ্নিকারীদের গ্রেপ্তার এবং যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত এবং মাদক থেকে অর্জিত অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় থাকা ৬১ শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে সাবরাং ইউনিয়নের আলীরডেইল গ্রামের বাসিন্দা আকতার কামাল নিহত হন এবং নয়াপাড়ার শামসুল আলম মার্কিনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয় কক্সবাজার থেকে। আকতার কামাল টেকনাফের সাংসদ আবদুর রহমান বদির ভাগনে সাহেদুর রহমান নিপুর সহযোগী ছিলেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, তালিকায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার আলিয়াবাদ গ্রামের মৃত এজাহার মিয়া কোম্পানির পাঁচ ছেলের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাংসদ বদি ছাড়া আর কেউ এলাকায় নেই। তালিকার শুরুর দিকে নাম থাকা কমপক্ষে ২০ জন এলাকাছাড়া। তবে তাঁদের বাণিজ্য চলছে। কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়া অন্যান্য গডফাদার চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ থেকে ব্যবসা করছেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। দ্বিতীয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল করিম, আবদুর রহমান বদির বড় ভাই আবদুস শুক্কুর ও তাঁর বোনের দেবর ছৈয়দ হোসেন দুবাই চলে গেছেন বলে খবর আছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় রাজধানী ঢাকায় শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩৭। তাঁদের মধ্যে মো. নাদিম ওরফে পচিশ ও মো. নজরুল ইসলাম ওরফে নজু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের কর্মকর্তা মুকুল জ্যোতি চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার সবচেয়ে বড় মাদক বিক্রেতা মো. ইসতিয়াক ওরফে কামরুল হাসান। তিনি কখনোই গ্রেপ্তার হননি। জানা গেছে, তালিকাভুক্ত অন্যদের গ্রেপ্তার করা গেলেও তাঁরা পরে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন এবং আবার মাদক ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপমহাপরিদর্শক এস এম রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, মাদক নির্মূল করতে হলে সীমান্ত নিশ্ছিদ্র করতে হবে। দেশের ভেতরে মাদক ঢুকে গেলে, সেটা উদ্ধার করে নির্মূল করা সম্ভব নয়। পুলিশ কতটা সফল জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাফল্য–ব্যর্থতা এখনই বলা যাচ্ছে না। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছালে বলা যাবে। তবে অভিযান কবে শেষ হবে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারেননি তিনি। পুলিশের সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা যে একেবারেই জড়িত নন, তা নয়। তবে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অভিযানের মধ্যেও ইয়াবা
অভিযানের সুফল জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের কর্মকর্তা খোরশিদ আলম বলেন, জোরেশোরে যখন অভিযান চলে তখন ইয়াবার দাম বাড়ে। রাজধানী ঢাকায় চম্পা (ছোট ইয়াবা) সর্বনিম্ন ১০০ টাকায় ও আর সেভেন (বড় ইয়াবা) ২০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন ছোটটা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা এবং বড়টা ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় পৌঁছেছে। তবে প্রকাশ্যে বেচাকেনা ও সেবন কমেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অন্য একটি বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। সেটা হলো, এখন নতুন নতুন বিক্রেতা দেখা যাচ্ছে। তাঁদের ধারণা, ব্যবসার হাত বদল হচ্ছে। জেনেভা ক্যাম্পে উপর্যুপরি অভিযানের পর মাদক ব্যবসা কিছুদিন থেমে ছিল। নতুন করে আবারও একটি চক্রের সক্রিয় হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে দাম বাড়ার বিষয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তার বক্তব্য আলাদা। তাঁরা বলছেন, মাদকবিরোধী অভিযান চলতে থাকায় ছোট ও মাঝারি মানের মাদক ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ একটু আড়ালে চলে গেছে। গডফাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে মাদকের নিরাপদ কেনাবেচা নিশ্চিত করার কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। তাই দাম বাড়তি।
এমন একটি চক্রকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির সংঘবদ্ধ অপরাধ দমন বিভাগের কর্মকর্তা মোল্যা নজরুল ইসলাম। জানা গেছে, গত মার্চে টেকনাফ থেকে ৫০ হাজার ইয়াবার চালান মুন্সিগঞ্জের শীর্ষস্থানীয় মাদক বিক্রেতা আরিফ ওরফে বাবা আরিফের কাছে আসছিল। মুঠোফোনে আড়ি পেতে পুলিশ ওই মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কিছু পুলিশ সদস্যের কথোপকথন থেকে ইয়াবার চালানের কথা জানতে পারে। শুধু একটি ঘটনাতেই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও রাজবাড়ীর চার পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
শুধু পুলিশের নিচের দিকের সদস্যরাই নন, পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আছে পুলিশের ওপরের দিকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও। গত জুনে রামুতে অভিযান চালিয়ে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি মনির-উজ-জামান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলীকে তিরস্কার করেন এবং আসামির নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিতে চাপ সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে মনির-উজ-জামানকে বদলি করা হয়। পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, গত এক বছরে মাদক কেনাবেচায় যুক্ত থাকার অভিযোগে শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক, টেকনাফ প্রতিনিধি ও যশোর প্রতিনিধি]