কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের আরাকান স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) ১১টি সশস্ত্র দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। মাদক, চাঁদাবাজি, মানব পাচার নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। ঘটছে ব্যক্তিভিত্তিক হত্যাকাণ্ড। দলগুলোর মধ্যে আরসার উপস্থিতি ও সন্দেহজনক কার্যক্রম নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে মন্ত্রণালয়টির দেওয়া এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়।
বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। তাঁরা মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসেন। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরগুলোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পৃথক তিনটি ব্যাটালিয়নের ২ হাজার ৩০০ সদস্য নিয়োজিত আছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আরসা সক্রিয় রয়েছে উখিয়া, বালুখালী, পালংখালী ও হোয়াইক্যং শিবিরে। আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সক্রিয় উখিয়া ও পালংখালী শিবিরে। হোয়াইক্যং শিবিরে সক্রিয় ইসলামি মাহাজ। উখিয়া ও পালংখালী শিবিরে মাস্টার মুন্না দল সক্রিয়। নয়াপাড়া শিবিরে সক্রিয় আছে ছয়টি দল। এগুলো হলো—চাকমা ডাকাত দল, নবী হোসেন ডাকাত দল, পুতিয়া ডাকাত দল, জাকির ডাকাত দল, সালমান শাহ ডাকাত দল ও খালেক ডাকাত দল। জাবু ডাকাত দল সক্রিয় হোয়াইক্যং ক্যাম্পে।
বেশির ভাগ শিবিরে আরসার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, কিছু শিবিরে নবী হোসেন দলের আধিপত্য আছে। শিবিরগুলোতে আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক সংঘর্ষ ঘটছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে আরসা ও নবী হোসেন দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক বিষয়গুলো আমলে নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। পুলিশের বিশেষ গোয়েন্দা শাখার তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে আরসা ও নবী হোসেন দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, ঘাঁটি উৎখাতের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনারও সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
আশ্রয়শিবিরের সবকিছু দেখভাল করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়। আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শিবিরগুলোয় অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়। গত শুক্রবারও একজনকে অপহরণ করা হয়। পরদিন গতকাল শনিবার তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এগুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে।
মিজানুর রহমান আরও বলেন, মূল সমস্যা হলো, নিজ দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন হয়নি। তাঁদের জন্মস্থান রাখাইনের পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়নি। যে কারণে তাঁদের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা রয়েছে। হতাশা থেকে তাঁদের মধ্যে বেপরোয়া আচরণ লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া এলাকাটি এমনিতেই মাদক-প্রবণ। দেশি দুষ্টচক্রের সঙ্গেও তাঁদের সংযোগ ঘটে গেছে। সেভাবেই তাঁদের মধ্যে গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সরকারের জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন জায়গায় এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে।
মিজানুর রহমান জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা–সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে। বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি এক্সিকিউটিভ কমিটি আছে। এই কমিটিতেও আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সবাই আছেন। সেখানেও এই বিষয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। শিবিরের ভেতরে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা এপিবিএন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও অভিযান চালানো হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটিতে ২০২১ ও ২০২২ সালে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, ২০২২ সালে শিবিরগুলোতে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। ২০২১ সালে শিবিরে ২২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২টি। অবশ্য অন্য অপরাধ গত বছর কিছুটা কম দেখা যায়। ২০২২ সালে শিবিরের চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৭৫টি। আগের বছর তা ছিল ৭৭টি। ২০২১ সালে ক্যাম্পে ১৭৩টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। গত বছর অপহরণের ঘটনা ঘটে ৮৬টি।
সবশেষ গত বুধবার রাতেও কক্সবাজারের একটি শিবিরে আরসা ও আরএসওর মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিতে রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) সলিম উল্লাহ (৩৪) নিহত হন। এই ঘটনায় আরএসওর পক্ষে ছিলেন নবী হোসেন দলের সদস্যরা।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে চার মাসে আশ্রয়শিবিরে ২০টির বেশি সংঘর্ষ-গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ৭ জন আরসার সদস্য, বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে তমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় গড়ে ওঠা কোনাপাড়া ক্যাম্পের কথাও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, সেখানে আরসার অবাধ বিচরণ রয়েছে। স্থানটি শূন্যরেখায় হওয়ায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা ও সার্বিক নজরদারি করা সম্ভব হয় না। ফলে এই শিবিরটি আরসার সাংগঠনিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।