গুলশানে এক দিনে চার ফ্ল্যাট কিনেছিল বেনজীর পরিবার
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের আরও সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে পাওয়া গেছে আরও ২৭৬ বিঘা (৯১ একর) জমি।
বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও এক মেয়ের নামে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট খুঁজে পেয়েছে দুদক। ফ্ল্যাটগুলোর আয়তন মোট ৯ হাজার ১৯২ বর্গফুট। এই চার ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল এক দিনে (২০২৩ সালের ৫ মার্চ) বেনজীর আহমেদ অবসরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে। দাম দেখানো হয়েছিল মাত্র ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
জমি ও ফ্ল্যাট ছাড়াও দুদক বেনজীর আহমেদ ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র খুঁজে পেয়েছে।
দুই দফা মিলিয়ে আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। তাঁর নামে প্রায় ৫২১ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল রোববার বেনজীর আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। দুদকের পক্ষে লিখিতভাবে সম্পদ জব্দের আবেদন করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম।
আবেদনের পক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর। তিনি আদালতকে বলেন, নতুন করে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে আরও অনেক সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন জেলায় তথ্য চেয়ে দুদক চিঠি দিয়েছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে তথ্য আসতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যে সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে, তা জব্দ ও অবরুদ্ধ না করা হলে হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে।
বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে, তার তিনটি তাঁর স্ত্রীর নামে। একটি ছোট মেয়ের নামে (আদালতে করা দুদকের আবেদন অনুযায়ী তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন)। দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৩৫৩ বর্গফুট, দাম ৫৬ লাখ টাকা করে। বাকি দুই ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ২৪৩ বর্গফুট করে, দাম সাড়ে ৫৩ লাখ টাকা করে।
শুনানির একপর্যায়ে আদালত পিপির কাছে জানতে চান, বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের মূল্য ও বিও হিসাবে কত টাকার শেয়ার আছে, তা জানেন কি না। জবাবে পিপি বলেন, তাঁরা বিস্তারিত জানতে পারেননি। জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দিলে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে আদালতকে জানানো হবে।
শুনানির পর আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে নতুন করে খুঁজে পাওয়া সম্পদ জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন। একই আদালত ২৩ মে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা প্রায় ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছিলেন।
সম্পদ জব্দের বিষয়ে গতকাল বেনজীর আহমেদের বক্তব্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। আদালতে করা আবেদনে দুদক বলেছে, বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এই সম্পদ (তফসিলে বর্ণিত) অবৈধভাবে অর্জন করেছেন। তাঁরা এই সম্পদ হস্তান্তর করার চেষ্টা করছেন।
৬২১ বিঘা জমি
দুই দফা মিলিয়ে আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। তাঁর নামে প্রায় ৫২১ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক।
বাকি ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে বেনজীর, তাঁর তিন মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জারা জেরিন বিনতে বেনজীর এবং স্বজন আবু সাঈদ মো. খালেদের নামে।
নতুন করে যে ২৭৬ বিঘা জমি পাওয়া গেছে, তার পুরোটাই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। জমিগুলো মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়। ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে এসব জমি কেনা হয়। দলিলমূল্য দেখানো হয় মোট ১০ কোটি ২২ লাখ টাকা। ফলে প্রতি শতাংশের দাম পড়েছে গড়ে সাড়ে ১১ হাজার টাকার মতো। বিঘা পড়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এর আগে খোঁজ পাওয়া ৩৪৫ বিঘা জমির দলিলমূল্য দেখানো হয়েছিল ১৬ কোটি ১৫ টাকার কিছু বেশি।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর স্ত্রীর নামে মাদারীপুরে জমিগুলো কেনা হয় তিনি আইজিপি থাকার সময়।
বেনজীর আহমেদ পুলিশে চাকরিরত থাকার সময় তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা কোনো পেশায় ছিলেন বলে জানা যায়নি। তবে সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বেনজীর এক ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মৎস্য খামার রয়েছে।
চার ফ্ল্যাট ‘পানির দামে’
বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে, তার তিনটি তাঁর স্ত্রীর নামে। একটি ছোট মেয়ের নামে (আদালতে করা দুদকের আবেদন অনুযায়ী তিনি তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন)। দুটি ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ৩৫৩ বর্গফুট, দাম ৫৬ লাখ টাকা করে। বাকি দুই ফ্ল্যাটের আয়তন ২ হাজার ২৪৩ বর্গফুট করে, দাম সাড়ে ৫৩ লাখ টাকা করে।
চারটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে একই দিন একই ভবনে। ভবনটির নাম র্যানকন আইকন টাওয়ার। হিসাব করে দেখা যায়, চারটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ২ হাজার ৩৮৩ টাকা দাম দেখিয়ে। আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার কোথাও এই দামে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব ছিল না। বৈশ্বিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) বরাত দিয়ে গত বছর দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব জানায়, রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম সবচেয়ে বেশি গুলশানে, প্রতি বর্গফুট ১৬৬ মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে ১৯ হাজার ৪২২ টাকার সমান।
কোম্পানির শেয়ার জব্দ
বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের শতভাগ মালিকানায় থাকা সাভানা ন্যাচারাল পার্ক, সাভানা ইকো রিসোর্ট ও একটি শিশির বিন্দু নামের প্রতিষ্ঠানের সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
আরও ১৫টি প্রতিষ্ঠানে থাকা বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের শেয়ার জব্দের আদেশও দেওয়া হয়েছে। তাঁদের শেয়ার রয়েছে নর্থ চিকস রংপুর, নর্দার্ন বিজনেস অ্যাসোসিয়েট, সেইন্ট পিটার্স স্কুল অব লন্ডন, স্টিলথ ইন্ডাস্ট্রিজ, বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি, ডেল্টা আর্টিসান, ইস্ট ভ্যালি ডেইরি, গ্রিন মাল্টিমিডিয়া, কমিউনিটি ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট, সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ল এনফোর্সমেন্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন, পুলিশ ট্রাস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট, পুলিশ ট্রাস্ট সার্ভিস অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট, পুলিশ ট্রাস্ট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এবং সাউদার্ন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ নামের প্রতিষ্ঠানে।