বগুড়ায় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বে ১৫ বছরে ৫১ খুন, নেপথ্যে কী
দলের পদ পাওয়া, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্য আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা, খুনোখুনি।
শাহজালাল তালুকদার ছিলেন বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁকে ধাওয়া করে কয়েকজন সন্ত্রাসী। তিনি একপর্যায়ে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁকে কুপিয়ে খুন করা হয়।
এই খুনের মামলার প্রধান আসামি করা হয় সাগর তালুকদারকে। তিনি পদে না থাকলেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। অভিযোগ আছে, আশেকপুর ইউনিয়নে ‘সাগর বাহিনী’ নামে তাঁর একটি বাহিনীও আছে।
শাহজালালের ভাই নুরুজ্জামান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০২০ সালে সাগর বাহিনীর হাতে খুন হন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শিহাব উদ্দিন। শিহাব খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তিনি (নুরুজ্জামান)। এ কারণে তাঁকে একবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। একই কারণে তাঁর ভাই শাহজালালকে খুন করা হয়।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, খুনের মামলার আসামিদের দলের পদ দেওয়া হয়। প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। কোনো কোনো মামলায় খুনের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়।
বগুড়ায় ১১ দিন অবস্থান করে জেলা পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জেলার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ, দলটির সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের ৫৮ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন ৫১ জন। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রধান কারণ দলের পদ পাওয়া, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, দখল, পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
৫১ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১০, যুবলীগের ২৫, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৯ ও ছাত্রলীগের ৭ জন। স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষেরা বলছেন, আধিপত্য বিস্তার এবং মাদক ও অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে প্রবণতা বেশি যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। এ কারণে এই দুই সংগঠনের নেতা–কর্মী খুনের সংখ্যা বেশি।
বগুড়ায় এই ৫১টি খুনের মামলায় শুধু একটির বিচার শেষ হওয়ার কথা জানা গেছে। সেটি হলো বগুড়া শহর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খায়রুল আনাম (রেক্কাত) হত্যা। এই ঘটনা ঘটেছিল ২০১২ সালে। মামলায় ১১ জন আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের নেতারাই বলছেন, খুনের মামলার আসামিদের দলের পদ দেওয়া হয়। প্রশাসনও কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না। কোনো কোনো মামলায় খুনের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে সমঝোতা করতে বাধ্য করা হয়।
বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া-৫ আসনের (শেরপুর-ধুনট) সংসদ সদস্য মজিবর রহমান (মজনু) এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের কাছে কোন্দল ও খুনোখুনির বিষয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। মজিবর রহমান বলেন, খুনোখুনি হচ্ছে, তবে দলের কোনো বিষয়ে নয়। খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে নিজেদের স্বার্থে, ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে। যাঁরা জড়িত, তাঁরা সন্ত্রাসী।
খুনের শিকার ও মামলার মূল আসামিরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের পদে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মজিবর রহমান বলেন, দু–একজনের পদ থাকতে পারে। সহযোগী সংগঠনের এসব পদের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
অন্যদিকে রাগেবুল আহসান দাবি করেন, আগে কিছু খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। এখন সেটা নেই বললেই চলে। খুনের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলে তিনি বলেন, এগুলো আওয়ামী লীগের মূল দলের নয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের। এগুলোর দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়।
অবশ্য বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নিয়ে ‘দলবাজি ও পেশিশক্তি’ বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
খুনোখুনি হচ্ছে, তবে দলের কোনো বিষয়ে নয়। খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে নিজেদের স্বার্থে, ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে। যাঁরা জড়িত, তাঁরা সন্ত্রাসী।বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বগুড়া-৫ আসনের (শেরপুর-ধুনট) সংসদ সদস্য মজিবর রহমান
দুই উপজেলায় খুনোখুনি বেশি
বগুড়া জেলায় ১২টি উপজেলা। এর মধ্যে সদর ও শাজাহানপুর উপজেলায় রাজনৈতিক খুনোখুনি বেশি। অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জেলায় খুন হওয়া ৫১ জনের মধ্যে ২৭ জনই এই দুই উপজেলার। স্থানীয় লোকজন বলছেন, বগুড়া সদর হলো ওই অঞ্চলের পরিবহন ব্যবসার কেন্দ্র। সেখানে পরিবহনকেন্দ্রিক ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়। মাদক ব্যবসা রয়েছে। শহরে চাঁদাবাজির সুযোগ বেশি।
অন্যদিকে শাজাহানপুর উপজেলাটি সদর উপজেলা লাগোয়া। শাজাহানপুরের একটি অংশ পড়েছে বগুড়া পৌরসভার মধ্যে। সেখানেও মাদক ব্যবসা, জমির ব্যবসা ও দখল, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে।
বগুড়া বিএনপির ‘ঘাঁটি’ বলে পরিচিত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বগুড়ায় বিএনপি নেতাদের আধিপত্য ছিল। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, তখন বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে পরিবহনে চাঁদাবাজি, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত হন আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বগুড়ায় মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তবে আওয়ামী লীগের মধ্যে কারা নিয়ন্ত্রক হবেন, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আগেও খুনোখুনি হয়েছে, সাম্প্রতিককালেও একই ঘটনা ঘটেছে।
নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী একজন নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। পদে থেকেও আমরা কিছু করতে পারছি না। দলে থাকা দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না।’
বগুড়া বিএনপির ‘ঘাঁটি’ বলে পরিচিত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও বগুড়ায় বিএনপি নেতাদের আধিপত্য ছিল। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, তখন বিএনপির প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সখ্য রেখে পরিবহনে চাঁদাবাজি, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ, দখলবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত হন আওয়ামী লীগ ও দলের সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী।
খুনের যত ঘটনা
বগুড়া পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ড পড়েছে শাজাহানপুর উপজেলার মধ্যে। এই ওয়ার্ডের ফুলতলায় বাড়ি যুবলীগের দুই নেতা আমিনুর রহমান (শাহীন) ও মজনু প্রামাণিকের। আমিনুর খুন হন ২০১১ সালে। দুই বছর পর খুন হন মজনু। সেই থেকে আমিনুর ও মজনুর সাত স্বজন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আমিনুরের স্বজন তিনজন, মজনুর চারজন।
স্থানীয় বাসিন্দা এবং আমিনুর ও মজনুর পরিবারের ১৩ স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমিনুর ছিলেন তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিনের ‘ক্যাডার’। ২০১৯ সালে মমতাজ উদ্দিন মারা যান। তার পর থেকে আমিনুরের পরিবারকে প্রশ্রয় দেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান (দুলু)। তিনি মজনু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। মজনু ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলামের (মোহন) ক্যাডার। এখনো পরিবারটি তাঁরই আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়।
বিষয়টি নিয়ে মঞ্জুরুল আলমের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মজনু হত্যা মামলা থেকে পুলিশ তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছে। এখন তাঁর পরিবার অনেক কিছু বলতে পারে। তারা বললেই অভিযোগ সত্য হবে না।
আমার স্বামীকে দলের (আওয়ামী লীগ) বড় বড় নেতারা ব্যবহার করেছেন। অথচ এই দলের লোকজনের হাতেই তিনি খুন হয়েছেন। বিচার পাওয়ার আশাও করি না।সুরভী বেগম
অবশ্য স্বজনেরাই বলছেন, নিহত আমিনুর ও মজনুকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এখনো তাঁদের স্বজনদের ব্যবহার করেন। তাই খুনোখুনি বন্ধ হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুন হন আমিনুরের ভাগনে ফোরকান আলী, যিনি যুবলীগ কর্মী ছিলেন। এই মামলায় আসামি করা হয়েছে মজনুর কয়েকজন স্বজনকে।
শাজাহানপুরের ফুলতলায় মজনু প্রামাণিকের বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী সুরভী বেগমের সঙ্গে কথা হয় গত ৩০ জুন। স্বামী হত্যার বিচার নিয়ে হতাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে দলের (আওয়ামী লীগ) বড় বড় নেতারা ব্যবহার করেছেন। অথচ এই দলের লোকজনের হাতেই তিনি খুন হয়েছেন। বিচার পাওয়ার আশাও করি না।’
২০২০ সালে পরিবহনে ‘চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার’কে কেন্দ্র করে খুন হন বগুড়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু হানিফ ওরফে মিস্টার। এ ঘটনায় হওয়া মামলায় প্রধান আসামি করা হয় জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ও পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলহাজ্ব শেখকে।
আলহাজ্ব শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। পুলিশ অভিযোগপত্র থেকে আমার নাম বাদ দিয়েছে।’
যদিও মামলার বাদী হানিফের বাবা আরমান আলী বলেন, মামলার অভিযোগপত্র থেকে আলহাজ্ব শেখের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি আদালতে নারাজি আবেদন করারও সাহস পাননি।
আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সহসম্পাদক নাজমুল হাসানকে (অরেঞ্জ), একই বছরের সেপ্টেম্বরে শেরপুর উপজেলায় পৌর আওয়ামী লীগ নেতা মর্তুজা কাওসারকে (অভি) এবং ২০২১ সালের জুলাইয়ে বগুড়া সদর উপজেলার ফাঁপোড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মমিনুল ইসলামকে (রকি) হত্যা করা হয়।
বগুড়ায় ‘টার্গেট কিলিং’ (পরিকল্পিত খুন) বেশি বলে উল্লেখ করেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী (সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক হয়েছেন)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে রাজনৈতিক কারণ, আধিপত্য বিস্তার, বালু ব্যবসা, হাটবাজারের ইজারার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা ঘটত। তবে গত দুই বছরে সেই সংখ্যা কমে এসেছে। এখন ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে খুনোখুনির ঘটনা বেশি ঘটছে।
জেলা পুলিশের হিসাবে, ২০১৫ সাল থেকে গত মে মাস পর্যন্ত ৯ বছর ৫ মাসে জেলায় খুন হয়েছেন মোট ৭৩৮ জন। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৭৭ জন খুন হন। অন্যদিকে পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, গত বছর একেকটি জেলায় গড়ে খুন হন ৪৭ জনের মতো (মোট ৩ হাজার ২৮ জন)। দেখা যাচ্ছে, বগুড়ায় অরাজনৈতিক খুনের ঘটনাও বেশি।
অরাজনৈতিক খুনের ঘটনায়ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম আসছে। গত ১৩ জুন বগুড়া শহরে দুই তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় মামলার আসামি করা হয়েছে বগুড়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বগুড়া জেলা পরিষদের সদস্য সৈয়দ সার্জিল আহম্মেদ (টিপু) এবং তাঁর ভাই ও জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদকে (মিঠু)।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, সড়কে গাড়ি (প্রাইভেট কার) দাঁড় করানো নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিতণ্ডার জেরে দুই তরুণকে খুন করা হয়।
পদ পান খুনের আসামিরাও
বগুড়ায় দলের নেতা-কর্মীদের খুনের মামলার আসামিদের দল ও সহযোগী সংগঠনে পদ দেওয়া হয়। ২০২১ সালের মার্চে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খানকে হত্যা করা হয়। মামলার অভিযোগপত্রের মূল আসামি সরকারি আজিজুল হক কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফকে তখন ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তবে ২০২৩ সালে তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাজেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত রউফকে অপরাধী বলার সুযোগ নেই। এ জন্য তাঁকে সংগঠনের পদ দেওয়া হয়েছে।
যুবলীগ নেতা মজনু ও তাঁর ভাগনে নাহিদ প্রামাণিককে খুনের মামলার আসামি করা হয়েছিল আসাদুর রহমানকে। তিনি এখন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের সদস্য।
যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগে আরও কয়েকজন নেতা রয়েছেন, যাঁরা হত্যা মামলার আসামি। তাঁদের পদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় অনেক কিছু তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
নব্বইয়ের দশক থেকে বগুড়ায় ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আইনজীবী আব্দুল লতিফ পশারী। গতকাল শুক্রবার মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া খুন আর পাল্টা খুনের শহর। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা, কথিত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং দুর্বৃত্ত ব্যবসায়ী। বিচার নিশ্চিত করা, কঠোর প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নজরদারি ছাড়া এই খুনোখুনি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
‘বুঝে গেছি, বিচার পাব না’
বগুড়া শহরের মালতীনগরে একটি আধা পাকা বাড়িতে বসবাস করে ২০২১ সালে খুন হওয়া ছাত্রলীগ নেতা তাকবীরের পরিবার। ৩ জুলাই রাতে সেই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে কতজনের কাছে গিয়েছি, সেটির হিসাব নেই। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমানের কাছেও গিয়েছি। একবার তো তিনি (মজিবর) বলেই ফেলেছেন, “বিচার পাওয়া এত সোজা।”’
বিষয়টি নিয়ে মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাটির বিষয়ে প্রথম দিকে আমিই খোঁজ নিতাম। তাকবীরের বাবা যা বলছেন, তা ঠিক নয়।’
অবশ্য তাকবীরের বাবা জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘মজিবর রহমান আমাকে বলেছিলেন, “যে (তাকবীর) খুন হয়েছে, সে আমার (মজিবর) একটা হাত। আবার যে খুন করেছে (স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রউফ), আরেকটা হাত। এখন কি আরেকটা হাত কেটে ফেলব।” তখনই বুঝে গেছি, বিচার পাব না।’
বাবা যখন ছেলের কথা বলছিলেন, তখন পাশে বসে নীরবে কাঁদছিলেন তাকবীরের মা আফরোজা ইসলাম।
মামলাটির বিষয়ে প্রথম দিকে আমিই খোঁজ নিতাম। তাকবীরের বাবা যা বলছেন, তা ঠিক নয়।জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান