আনোয়ারুল হত্যা: আক্তারুজ্জামান এলাকায় এখনো এক ‘রহস্য’
কোটচাঁদপুরের লোকজন আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনকে ক্ষমতাবান মনে করত, সমীহ করে চলত। এলাকায় এলে তিনি থাকতেন বাগানবাড়িতে। সেখানে আসা–যাওয়া ছিল প্রভাবশালী নানা লোকজনের। কিন্তু তিনি আসলে কী করতেন, তাঁর ক্ষমতার উৎস কী, সেটা স্থানীয় লোকজনের কাছে বিরাট এক ‘রহস্য’ হয়ে আছে। আনোয়ারুল আজীম খুনে তাঁর নাম আসার পর তাঁর নাম এখন সবার মুখে মুখে।
ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় ঢাকা ও কলকাতার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আক্তারুজ্জামানই এই খুনের মূল পরিকল্পনাকারী।
সরকারি একাধিক সংস্থাসহ ওয়াকিবহাল বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আক্তারুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরে ঝিনাইদহ সীমান্তকেন্দ্রিক সোনা চোরাচালানে যুক্ত। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। চোরাচালানের বিরোধেই সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে খুন করিয়েছেন বলে মনে করছে তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
আক্তারুজ্জামানের বাড়ি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা সদরে। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, গত ১০ বছরে আক্তারুজ্জামান ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব রাখেন। সর্বশেষ কোটচাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনে তাঁর ভাই সহিদুজ্জামান ওরফে সেলিম আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে আক্তারুজ্জামান বিপুল অর্থ খরচসহ নানাভাবে প্রভাব খাটিয়েছেন বলে এলাকায় প্রচার আছে।
আনোয়ারুল আজীম খুন হওয়ার পর থেকে আক্তারুজ্জামান পলাতক। তারপরও তাঁর বিষয়ে স্থানীয় লোকজন বেশি কিছু বলতে সাহস পান না। দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে আক্তারুজ্জামানের যোগাযোগ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে। এই দুজন সংসদ সদস্যের প্রভাবে আনোয়ারুল আজীমের রাজনৈতিক উত্থান হয় বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা গেছে, আনোয়ারুল আজীমই এই দুই প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সঙ্গে বন্ধু আক্তারুজ্জামানকে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
কোঁটচাদপুর উপজেলার চারজন আওয়ামী লীগ নেতা আক্তারুজ্জামানের বিষয়ে তথ্য দিলেও নাম প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এমনকি ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের দুজন নেতাও আক্তারুজ্জামানের বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে। তাঁর একজনের ভাষ্য, আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক রয়েছে, তাতে যে কাউকে ‘নাই’ করে দিতে পারেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আক্তারুজ্জামানের ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র সহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আক্তারুজ্জামান যেভাবে মানুষ হয়েছেন, তাতে যেসব অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, সেটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন আক্তারুজ্জামানের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে যা পাওয়া যায়, সে অনুযায়ী দেশের প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, আক্তারুজ্জামান এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সিঙ্গাপুর যান। এরপর সোনা চোরাচালানে যুক্ত হন। তিনি বিদেশ থেকে ঝিনাইদহের পরিতোষ চক্রবর্তী ও বন্ধু আনোয়ারুলের কাছে সোনা পাঠাতেন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, তরুণ বয়সে খেলাধুলা করতে গিয়ে আনোয়ারুল ও আক্তারুজ্জামানের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। পরে আনোয়ারুলের মাধ্যমে সোনা চোরাচালানে যুক্ত হন আক্তারুজ্জামান। এই ক্ষেত্রে দুজনের গুরু ছিলেন পরিতোষ চক্রবর্তী। ঝিনাইদহ শহরের সোনার ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত পরিতোষ ২০১৩ সালে মারা যান। এরপর আনোয়ারুল ও আক্তারুজ্জামান ঝিনাইদহ সীমান্তকেন্দ্রিক চোরাচালানের বড় নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।
রহস্যঘেরা বাগানবাড়ি
বছর পাঁচেক আগে কোটচাঁদপুরের এলেঙ্গীতে ৩০ বিঘা জমির ওপর একটি বাগানবাড়ি করেন আক্তারুজ্জামান। গত শুক্রবার সকালে ওই এলেঙ্গী এলাকায় গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উঁচু প্রাচীরঘেরা বাগানবাড়িতে স্থানীয় লোকজনের প্রবেশ নিষেধ ছিল। ওই বাগানবাড়ির ভেতরে কী হতো, সেটি তাঁদের জানা নেই। তবে প্রায়ই বিলাসবহুল গাড়ি ঢুকতে ও বের হতে দেখতেন এলাকার মানুষজন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, এই বাগানবাড়িতে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের অনেকের যাতায়াত ছিল। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমেরও যাতায়াত ছিল।
আনোয়ারুল খুন হওয়ার পর সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, আক্তারুজ্জামান বেশির ভাগ সময় বিদেশে অবস্থান করেন। তিনি দেশে এলে এলাঙ্গীর বিলাসবহুল বাড়িতে আমোদ-ফুর্তি করতেন।
ঝিনাইদহ জেলা পুলিশ সুপার আজিম-উল-আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ওই বাগানবাড়ি সম্পর্কে তিনি তেমন কোনো তথ্য জানেন না। তবে সেখানে কোনো অপরাধ হয়েছে কি না, সেটা দেখার দায়িত্ব পুলিশের। বাগানবাড়িতে অপরাধ হয়েছে, এমন কোনো তথ্য বা অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেনি।
চরমপন্থী যোগাযোগ
আক্তারুজ্জামানের চাচাতো ভাই মিজানুর রহমান (টুটুল) চরমপন্থী সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) প্রধান ছিলেন। তিনি পরে পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে মারা যান। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়া একসময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির খুলনা অঞ্চলের নেতা ছিলেন। যিনি পুলিশের কাছে পেশাদার খুনি হিসেবে পরিচিত। এই শিমুল আবার মিজানুর রহমানের শ্যালক। এই সূত্র ধরেই আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে শিমুল ভূঁইয়ারও পুরোনো সখ্য রয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী অবৈধ কারবারির সঙ্গে অপরাধজগতের একটা ঘনিষ্ঠতা থাকে। ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও যশোর অঞ্চলের অপরাধজগতের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে কথিত চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা। সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে খুনের ঘটনায়ও সেই চরমপন্থী সন্ত্রাসীদেরই ব্যবহার করা হয়েছে। আর ঘটনাস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কলকাতায় আক্তারুজ্জামানেরই ভাড়া করা ফ্ল্যাট। ঢাকার অভিজাত এলাকায়ও তাঁর একাধিক ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। এসব বাসায় বসেই খুনের পরিকল্পনা করা হয় বলে ঢাকায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।