জেল পালানোর ঘটনার তদন্ত হয়, শাস্তি শুধুই ‘বদলি’

তদন্তে শাস্তির সুপারিশ থাকলেও বেশির ভাগ দোষীকে সতর্ক ও বদলি করা হয়। কয়েক মাস না যেতেই প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন।

বালতির হাতল ও স্কু ড্রাইভার ব্যবহার করে এভাবে ছাদ ফুটো করে পালিয়েছিলেন ফাঁসির চার আসামি।ছবি: সংগৃহীত

যেন সিনেমার গল্প। এক-দুই দিন নয়, ২৫ দিন ধরে অ্যালুমিনিয়ামের বালতির হাতল দিয়ে একটু একটু করে ছাদ ফুটো করা হয়েছে। শেষে সুযোগ বুঝে পলায়ন। বন্দী পালানো নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন, প্যাপিলন, এসকেপ ফ্রম প্রিটোরিয়া বা কুল হ্যান্ড লিউক—এমন আরও আরও। সিনেমার এ কাহিনি বাস্তবে প্রমাণ করে দিয়েছেন বগুড়া জেলা কারাগারের চার বন্দী।

কারাগারের কনডেমড সেলের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই চার আসামির পালানোর ঘটনায় অত্যন্ত বিব্রত কারা কর্তৃপক্ষ। কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) অসন্তোষ প্রকাশ করে দেশের ৬৮টি কারাগারের সব জেল সুপারকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। বলেছেন, এমন ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত, যা দেশে কারাগারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। এ ধরনের শৈথিল্য অগ্রহণযোগ্য।

২০২১ সালের মার্চে ফরহাদ হোসেন ওরফে রুবেল (২০) নামে খুনের মামলার এক আসামি চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যান। তিনি কারাগারের চারতলা একটি ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে ২২ ফুট দূরের ১৮ ফুট উঁচু দেয়াল ডিঙিয়ে পালিয়ে যান। তখন কারা কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হয় শুধু ‘তিরস্কার’।

কারা বিশ্লেষকেরা বলছেন, কারাগারের অনিয়ম ও অবহেলার ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হলেও শাস্তি হয় হাতে গোনা। অনিয়মের শাস্তি শুধুই বদলি। তদন্ত প্রতিবেদনে কঠোর শাস্তির সুপারিশ থাকে। বাস্তবে বেশির ভাগ দোষীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কম গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে বদলি করা হয়। কয়েক মাস না যেতেই প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা ফিরে আসেন গুরুত্বপূর্ণ পদে।

আরও পড়ুন

পর্যালোচনায় দেখা যায়, কারাগারের ভেতরে বসে মই তৈরি করে সেটি বেয়ে প্রধান ফটক পার হয়ে পালিয়ে যান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক। এ ঘটনা ২০২০ সালের আগস্টে কাশিমপুর কারাগারে। এই ছিদ্দিক আগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন। দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই বন্দীর ২০১৫ সালে একবার নিখোঁজ হওয়ার নজির ছিল। পালানোর সময় তাঁর পরনে কয়েদির পোশাক ছিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কারারক্ষীরা কেউ বাধাও দেননি। মই বানাতে দেখলেও কেউ জানতে চাননি, এটা দিয়ে কী হবে।

এ ঘটনার পরদিন এই হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে একই ধরনের বন্দী একইভাবে আদালতে পাঠানো হয়। তখন ঢাকার একজন ডিআইজিকে বদলি করা হলেও কাশিমপুর কারাগারে কোনো কর্মকর্তাকে বদলি বা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আবু বক্কর ছিদ্দিক মই নিয়ে সাধারণ পোশাকে ব্রহ্মপুত্র ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে যখন বের হচ্ছিলেন, তখন তাঁর আশপাশে দায়িত্বরত কারারক্ষীরা ছিলেন। তাঁরা ঘোরাফেরা ও গল্প করছিলেন। ছিদ্দিক মইটি কাঁধে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র ভবনের বাইরের ফটক দিয়ে বেরিয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে কারাগারের মূল ফটকের দিকে যান। তিনি কোনো বাধার মুখে পড়েননি।

এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছে, জেল সুপার ও জেলার যদি কারা অভ্যন্তরে আরও তদারকি করতেন এবং ডেপুটি জেলাররা যদি তাঁদের নির্দিষ্ট এলাকাগুলো নিয়মিত ঘুরতেন এবং কারারক্ষীরাও যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে কারাগারের ভেতরে মই থাকত না। তদন্তে কারা কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হয়। কাশিমপুর কারাগারের তৎকালীন জেলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও জেল সুপার জাহানারা বেগমের শুধু এক বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়েছিল। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ কারাগারের জেল সুপার।

আরও পড়ুন

২০২১ সালের মার্চে ফরহাদ হোসেন ওরফে রুবেল (২০) নামে খুনের মামলার এক আসামি চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যান। তিনি কারাগারের চারতলা একটি ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে ২২ ফুট দূরের ১৮ ফুট উঁচু দেয়াল ডিঙিয়ে পালিয়ে যান। তখন কারা কর্মকর্তাদের শাস্তি দেওয়া হয় শুধু ‘তিরস্কার’।

২০১৬ সালের মে মাসের একটি ঘটনা—খুনের মামলার কারাবন্দী আসামি তারেক উদ্দিন চুরির মামলার আসামি মোহম্মদ হোসেন সেজে বেরিয়ে যান। এর সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সম্পৃক্ততা ছিল। অসুস্থ দেখিয়ে এই দুই বন্দীকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে তাঁদের একই কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৫ সালের ১৯ মে রাজধানীর শাহজাহানপুরে উত্তরা ব্যাংকের সামনে ব্যবসায়ী জহির উদ্দিনকে গুলি করে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যান তিন মোটরসাইকেল আরোহী। এঁদের একজন তারেক উদ্দিন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা জহিরকে মৃত ঘোষণা করেন।

কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসা কারাবন্দীদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও বেড়েছে। রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড হাসপাতাল) থেকে পালিয়ে যান মিন্টু মিয়া নামের এক আসামি। পরে তাঁকে বাবুবাজার এলাকা থেকে আটক করে কারাগার কর্তৃপক্ষ। এর আগে যশোরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশনে ভর্তি থাকা আসামি সুজন মল্লিক (২৫) জানালার গ্রিল ভেঙে পালান। এ ছাড়া হারুনুর রশিদ নামের ডাকাতি মামলার এক আসামি ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানা থেকে পালান।

কারাগারে জেল সুপার বা জেলার হিসেবে কাজ করছেন বা আগে করেছেন, এমন একাধিক‍ কর্মকর্তা এসব ঘটনার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, কারা বিভাগে বদলি ও পদায়নের প্রথাগত একটি ব্যবস্থাপনা ছিল, যা এখন মানা হচ্ছে না।

অন্যদিকে ২০২২ সালের নভেম্বরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) হেফাজতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আনা হয়েছিল। দুপুরে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ সদস্যদের চোখে স্প্রে করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মইনুল হোসেন শামীম ও আবু ছিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। পালিয়ে যাওয়া দুজন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (সাবেক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) সদস্য। এ ঘটনার পরদিন এই হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে একই ধরনের বন্দী একইভাবে আদালতে পাঠানো হয়। তখন ঢাকার একজন ডিআইজিকে বদলি করা হলেও কাশিমপুর কারাগারে কোনো কর্মকর্তাকে বদলি বা কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কারাগারে জেল সুপার বা জেলার হিসেবে কাজ করছেন বা আগে করেছেন, এমন একাধিক‍ কর্মকর্তা এসব ঘটনার জন্য কারা কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, কারা বিভাগে বদলি ও পদায়নের প্রথাগত একটি ব্যবস্থাপনা ছিল, যা এখন মানা হচ্ছে না। অতীতে অভিজ্ঞ, অপেক্ষাকৃত দক্ষ, যোগ্য, সাহসী ও সক্ষম জেল অফিসারদের বড় বা জেলা কারাগারে পদায়ন করা হতো। এখন অভিজ্ঞতা নেই এমন কর্মকর্তাদের বদলি বা পদায়ন করা হচ্ছে বড় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার, জেল সুপার ও জেলার হিসেবে। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ঘটার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এবং কারা বিভাগের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

কারাগার কর্তৃপক্ষের অবহেলা তো ছিলই। তবে তদন্তের পর বোঝা যাবে, কারা দায়ী। জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান

বগুড়া কারাগারের বর্তমান জেলার নেত্রকোনা কারাগারে থাকার সময় সাধারণ মানুষকে দিয়ে ‘ফায়ারিং’ করানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তখন সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক তাঁকে বিভাগীয় শাস্তি দিয়েছিলেন। অনেকবার তাঁকে প্রশাসনিক কারণে বদলিও করা হয়েছে। তাঁকেই আবার বগুড়ার মতো কারাগারে পদায়ন করা হয়।

সর্বশেষ বগুড়া জেলা কারাগারের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, কারাগার কর্তৃপক্ষের অবহেলা তো ছিলই। তবে তদন্তের পর বোঝা যাবে, কারা দায়ী। জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।