খুন করার আগে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের মুখে চেতনানাশক দেওয়া রুমাল চেপে ধরেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান। কিছুক্ষণের মধ্যেই অচেতন হয়ে পড়লে দড়ি দিয়ে তাঁকে চেয়ারে বেঁধে ফেলেন ফয়সাল আলী।
মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিতে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) করা আবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিবির আবেদনের ভিত্তিতে দুজনকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে আদালতে দেওয়া আবেদনে ডিবি বলেছে, খুন হওয়ার আগে ওই ফ্ল্যাট (ভারতের কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনস) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আনোয়ারুল আজীম। তখন পেছন থেকে তাঁর মুখে ক্লোরোফর্ম (চেতনানাশক) মিশ্রিত রুমাল চেপে ধরেন মোস্তাফিজুর। এরপর আনোয়ারুল আজীমের হাত চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন ফয়সাল।
ডিবি সূত্র বলছে, খুনে যাঁরা সরাসরি অংশ নিয়েছেন, তাঁদের প্রধান ছিলেন চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া। খুনের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন। শিমুল ও আক্তারুজ্জামান বড় অঙ্কের অর্থ দেওয়ার কথা বলে গত ২ মে মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে কলকাতার একটি হোটেলে নিয়ে রাখেন। যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীম খুন হন, সেই ফ্ল্যাটে ১০ মে ওঠেন মোস্তাফিজুর। এর দুই দিন পর ১২ মে ফয়সালও সেখানে ওঠেন। এর পরদিনই (১৩ মে) এই ফ্ল্যাটে ব্যবসায়িক কাজের কথা বলে ডেকে এনে খুন করা হয় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে।
খুনের ছয় দিন পর মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল ঢাকায় ফিরে আত্মগোপনে চলে যান। গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
গ্রেপ্তারের পর ডিবি সাংবাদিকদের বলেছিল, ধর্মীয় পরিচয় গোপন করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-সংলগ্ন ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকার পাতাল কালীমন্দিরে ২৩ দিন আত্মগোপনে ছিলেন মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল। মন্দিরের লোকজনের কাছে মোস্তাফিজ নিজের পরিচয় দেন শিমুল রায় নামে। ফয়সালের পরিচয় ছিল পলাশ রায়। তাঁরা যে খুনের মামলার আসামি কিংবা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক নন, তা বুঝতে পারেননি মন্দির দেখভালের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। ওই দুজন মন্দিরে প্রার্থনায় বসতেন, প্রসাদও গ্রহণ করতেন।
খুনের মামলার তদন্ত সম্পর্কে আজ রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিমএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করেছে ডিবি। সেখানে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে খুন করার আগে কলকাতার একটি মার্কেট থেকে ১৭ হাজার টাকায় একটি চেয়ার কিনে ওই ফ্ল্যাটে (সঞ্জিভা গার্ডেনসে) নিয়ে যান ফয়সাল। চেতনানাশকও (ক্লোরোফর্ম) কিনেছিলেন তিনি। অচেতন করার পর এই চেয়ারেই আনোয়ারুল আজীমকে বেঁধে ফেলেন মোস্তাফিজুর।
ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র (ধারালো সরঞ্জাম) ফয়সালকে এনে দিয়েছিলেন আরেক আসামি সিয়াম হোসেন (নেপালে আটক হওয়ার পর এখন ভারতে)। খুনের পর মোস্তাফিজ ও ফয়সাল দেশে ফিরে শাহীনকে (আক্তারুজ্জামান) ফোন করেন। পরে তাঁদের ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা নিয়ে দুজনে চলে যান খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের গহিন অঞ্চলে। পরে তাঁরা পাহাড়ি এলাকার পাতাল কালীমন্দিরে যান। সেখানে তাঁরা নিজেদের নাম বদলে ফেলেন ও চুলের ধরন পরিবর্তন করেন। হিন্দু সেজে মন্দিরে অবস্থান করার পাশাপাশি ধুতি পরে চলাফেরা করতেন।
ডিবি সূত্র বলছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাতজন। এর মধ্যে মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল ছাড়া চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শেষের তিনজন অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এর বাইরে কলকাতার পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ‘কসাই’ জিহাদ হাওলাদারকে। আর নেপালে আটকের পর ভারতে নেওয়া হয়েছে মো. সিয়াম হোসেনকে।
এর বাইরে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম (মিন্টু) এবং একই কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে বাবুকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। দুজনের মধ্যে কাজী কামাল অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, দুটি মুঠোফোন তিনি ঝিনাইদহের গাঙ্গুলী হোটেলের পেছনের পুকুরে ফেলেছেন। আরেকটি মুঠোফোন ফেলেছেন স্টেডিয়ামের পেছনের পুকুরে। কাজী কামালের সঙ্গে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী শিমুল ভূঁইয়ার যোগাযোগ হয়েছিল ওই তিনটি মুঠোফোনে।
মুঠোফোনগুলো উদ্ধারে গতকাল কাজী কামালকে নিয়ে ঝিনাইদহে অভিযান চালায় ডিবি।
আনোয়ারুল আজীম খুনে সরাসরি জড়িত হিসেবে চিহ্নিত সাতজনকে গ্রেপ্তারের পরও এই খুনের কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট নয় ডিবি। এ বিষয়ে ডিবির প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, যেকোনো হত্যার পেছনে একটা মোটিভ (উদ্দেশ্য) থাকে। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট মোটিভ (হত্যার কারণ) বের করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সম্ভাব্য সব কারণ আমলে নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়া দুজনকেও রিমান্ডে নিয়ে হত্যার সম্ভাব্য সব কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’