সন্ধ্যায় এলেন নতুন গৃহকর্মী, পরদিন সকালে তাঁর জন্য মাথায় হাত

রহিমা নামে পরিচয় দেওয়া ওই নারীর বাসায় ঢোকার সময়ের ছবি ধরা পড়েছে সিসিটিভি ক্যামেরায়
ছবি: সংগৃহীত

রহিমা নামে গৃহকর্মী পরিচয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গ্রিন রোডে কাকলি খানের বাসায় ঢোকেন মধ্যবয়সী এক নারী। আর শুক্রবার সকালে সবার চোখের সামনে দিয়ে চারটি মুঠোফোন, চার লাখের বেশি টাকা ও গয়না নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। সকাল থেকে কাকলি খানের আফসোস, কেন তিনি রহিমার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি ও অন্যান্য তথ্য রাখলেন না।

কাকলি খান শুদ্ধ কৃষি নামের উদ্যোগের স্বত্বাধিকারী। তিনি জানালেন, রহিমা পরিচয় দেওয়া ওই নারীকে বাসার দারোয়ান আবদুস সালাম (৬০) তাঁর বাসায় কাজের জন্য দিয়ে আসেন। কাকলি খান তখন বাসায় ছিলেন না। ছিলেন তাঁর বৃদ্ধ মা–বাবা। পরে বাসায় ফিরলে কাকলি ও তাঁর স্বামী আবসাল শাকিব কোরেশির সঙ্গে দেখা হয় ওই নারীর।

কাকলি খানের ভাষ্যমতে, তিনি কলাবাগান থানায় জমা দেওয়ার জন্য ওই নারীর কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চান। এর পরপরই তিনি এক বন্ধুকে দেখতে হাসপাতালে যান। ফলে পরিচয়পত্র আর নেওয়া হয়নি। তাঁর স্বামী ব্যক্তিগত কাজে রাতে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেননি। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফেরেন কাকলি। ততক্ষণে তিনি ঘুমিয়ে যান। কাকলি ডাকতে চাইলে তাঁর মা বলেন, এখন ঘুম না ভাঙিয়ে সকালে তথ্য নিলেই হবে।

কাকলি বলেন,‌‌ ‘আমার এক মেয়ের বয়স ১০ বছর। আরেক মেয়ের বয়স মাত্র এক বছর পার হয়েছে। বাসায় আমি, আমার স্বামী আর আমার বৃদ্ধ মা–বাবা থাকেন। বাসায় সাহায্যকারী না থাকায় বিপদের মধ্যে ছিলাম। আমি রাত আড়াইটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম ব্যবসায়িক ও অন্যান্য কাজের জন্য। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। সকাল ছয়টার দিকে মা আমার মেয়ের জন্য দুধ বানিয়ে দিয়ে গেলে আমি ঘুমের ঘোরেই মেয়েকে তা খাইয়ে আবার ঘুমিয়ে যাই। মা–ও ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর ঘুম ভেঙে দেখি রহিমা নেই। আমার চারটি মুঠোফোন, দুই জায়গায় রাখা ব্যবসার চার লাখ টাকা, বাবার পকেট থেকে চার হাজার টাকা, আমার একটি হীরার আংটিসহ গয়না এবং মেয়েদের চেইনসহ সব গয়না নিয়ে সে পালিয়ে গেছে।’

কাকলি বলেন, ব্যবসার সাড়ে ৩ লাখ টাকা বিছানার পাশে একটি টেবিলের ওপরে খামে এবং আরেক জায়গায় ৪৪ হাজার টাকা রাখা ছিল। রাতে আলসেমি করে টাকা ড্রয়ারে রেখে তালা দেওয়া হয়নি। আর সব সময় যে গয়নাগুলো পরেন, সেগুলো বিভিন্ন কৌটায় রাখা ছিল। হীরার একটি আংটিও ছিল। রুমের দরজা খোলা ছিল।

চারটি মুঠোফোনের একটি তাঁর বালিশের নিচ থেকে নিয়েছে জানিয়ে কাকলি বলেন, ‘সকালে ঘুম ভেঙে বুঝতে পারি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে। ঘুমের মধ্যে রহিমা কিছু করেছে কি না, বুঝতে পারছি না। আমি দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের নিয়ে কাজ করি। এই কৃষকদের নম্বরসহ সব তথ্য মুঠোফোনে রয়েছে। মুঠোফোন উদ্ধার না হলে আমার ব্যবসার অনেক বড় ক্ষতি হবে। গৃহকর্মী বাসায় রাখলে থানায় তথ্য জানাতে হয়, তা জানার পরও বড় একটি ভুল করে ফেললাম।’

কাকলি খান গ্রিন রোডের ফ্ল্যাটটিতে আছেন দেড় বছর ধরে। আর দারোয়ান আবদুস সালাম প্রায় ১৪ বছর ধরে ওই ভবনে দায়িত্ব পালন করছেন। এই ঘটনার সঙ্গে দারোয়ানের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি না, তা নিশ্চিত নন বলে জানালেন কাকলি খান। প্রাথমিকভাবে দারোয়ানের সম্পৃক্ততা নেই বলেই তাঁর মনে হচ্ছে।

শুক্রবার সকালে কাকলি খান যখন বুঝতে পারেন, রহিমা সব নিয়ে পালিয়েছেন, তখন তিনি কলাবাগান থানায় যান। কাকলি জানালেন, তখন থানায় সাধারণ ডায়েরি নেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না বলে জানানো হয়। তবে পরে থানা থেকে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) শামসুল হকসহ আরেকজন বাসায় এসে সব তথ্য নিয়ে গেছেন। দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে গেছেন।

কাকলি খান বলেন, বাসার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রহিমার ছবি আছে। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা বলে জানিয়েছিলেন। তবে এসব তথ্য সঠিক কি না, তা বলার উপায় নেই। দারোয়ানের প্রসঙ্গে কাকলি খান বলেন, ‘আমি বা আমার স্বামী যেহেতু বাসায় ছিলাম না, তাই রহিমাকে বাসায় দিয়ে আসা ঠিক হয়নি দারোয়ানের। আর আমাদের নিজেদের ভুল তো হয়েছেই।’

কাকলি খান জানালেন, তাঁর স্বামী বিজনেস ইন্টেলিজেন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বাসায় ফিরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বাসায় গৃহকর্মী রাখার বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেও ডিএমপি গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে খেয়াল রাখতে বলেছে। সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ফরমে গৃহকর্মী ও গাড়ির চালকদের তথ্য দেওয়ার ঘর রাখা আছে। যিনি গৃহকর্মী রাখবেন, তাঁর দায়িত্ব ফরমটি পূরণ করে থানায় দিয়ে আসা। পুলিশের পক্ষ থেকে এ ফরম বিভিন্ন সময় নগরীর বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসা হয়েছে।  

ডিএমপির নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গৃহকর্মী নিয়োগের আগে তাঁর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, সদ্য তোলা রঙিন ছবি, শনাক্তকারী ব্যক্তি, ওই ব্যক্তির পরিচয় ও তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে হবে। তথ্যগুলো স্থানীয় থানায় জমা দিতে হবে। নিজের কাছেও রাখতে হবে। এর আগে গৃহকর্মী কোথায় কাজ করেছেন, তার বিস্তারিত তথ্য, কাজ ছাড়ার কারণ এবং প্রয়োজনে ওই ঠিকানায় যোগাযোগ করে তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী, গৃহকর্মীর পরিবারে তথ্য, স্থায়ী ঠিকানা ও পরিবারে কে কে আছেন, তা জানতে হবে। প্রয়োজনে স্থায়ী ঠিকানায় যোগাযোগ করতে হবে।

গৃহকর্মী নিয়োগের পর তাঁর গতিবিধি লক্ষ করতে হবে। বাসার মূল ফটকে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর পাশাপাশি ঘরের মধ্যেও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, বাসায় মূল্যবান জিনিসপত্র সাবধানে রাখা, সন্দেহজনক কারোর সঙ্গে গৃহকর্মী মুঠোফোনে কথা বলছেন কি না—এমন সব বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

এ বিষয়ে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সচেতনতাবোধ কবে জাগবে, তা জানি না। গৃহকর্মীর জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা তো দূরের কথা, অনেকে নামটাও জানেন না। সব নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থানায় আসেন। গৃহকর্মীর নাম জানতে চাইলে বলেন, নাম তো জানি না, বুয়া বলে ডেকেছি। এই হলো অবস্থা। অথচ গৃহকর্মীর জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব তথ্য থাকলে পালিয়ে গেলেও পুলিশের পক্ষে তাঁকে ধরা অনেক সহজ হয়।’

মো. সাইফুল ইসলাম আরও জানালেন, কাকলি খান আইনি প্রক্রিয়ায় এগোলে রহিমা নামের গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।