সাইবার জগতে নতুন নতুন ফাঁদ
ব্যবহারকারীর অজান্তে ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা ঘটছেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার ফাঁদে ফেলার মাধ্যমে প্রতারণা। আবার দামি রেস্তোরাঁয় খাবারের ভুয়া ফরমাশ দেওয়াসহ নানা কায়দায় মানুষের কাছ থেকে অর্থ বের করে নেওয়া হচ্ছে। গত আড়াই বছর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে আসা ৪০৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে অনলাইন অপরাধের এসব ধরন সম্পর্কে জানা গেছে।
ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের (উত্তর বিভাগ) উপকমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, সাইবার অপরাধের নতুন নতুন ধরন সামনে আসছে। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণার ঘটনাই বেশি ঘটছে।
মামলা বিশ্লেষণ করে নতুন ধরনের যেসব অপরাধের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, কিছু বিদেশি নাগরিক ঋণের ফাঁদে ফেলে অনেক ব্যক্তির কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ফেসবুকসহ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। ওই ঋণ পেতে হলে তাঁদের নির্দিষ্ট অ্যাপ নামাতে হচ্ছে। একবার এই অ্যাপ নামালেই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। অ্যাপ দিয়ে ওই ব্যক্তির সব ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য (পাসওয়ার্ড, ছবি–ভিডিও ইত্যাদি) হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। এরপর তাদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিলেও সুদসমেত ৫০ হাজার টাকা দাবি করার ঘটনাও ঘটছে। আর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই সব ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
অনলাইনে প্রতারণার আরেকটি নতুন ঘটনা সামনে এসেছে গত রমজান মাসে। রাজধানীর একটি খ্যাতনামা রেস্তোরাঁর নামে ভুয়া ফেসবুক পেজ খুলে ‘সাহ্রি ও ইফতারের খাবারে আকর্ষণীয় মূল্যছাড়!’ বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেটা দেখে অনেকেই সাহ্রি ও ইফতারের ফরমাশ দিয়ে মুঠোফোনে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেছিলেন। পরে খেতে গিয়ে তাঁরা দেখেন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ ঘটনায় নড়াইলের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার ডিবি পুলিশ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, নড়াইলে বসে তাঁরা একটি চক্র গড়ে তুলে এই প্রতারণা করছিলেন।
এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অঞ্চলভিত্তিক বেশ কিছু সাইবার অপরাধী চক্র শনাক্ত করেছেন। কিছু সদস্যকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
ডিবি সূত্র জানায়, ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালী এলাকাভিত্তিক চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিং-সংক্রান্ত প্রতারণা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইমো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতারণায় জড়িত নাটোরের লালপুরকেন্দ্রিক একাধিক চক্র। ই-কর্মাসের নামে ফেসবুক পেজ খুলে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির আড়ালে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িত নড়াইলভিত্তিক আরেকটি চক্র। রংপুর ও নীলফামারী এলাকায় একাধিক প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে। তারা রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিচিত ব্যক্তিদের ছবি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে।
এগুলো ছাড়াও অনলাইনে প্রতারণার নানা ঘটনা ঘটছে। গোয়েন্দা পুলিশের এই বিভাগের হাতে আসা ৪০৬টি মামলার মধ্যে অনলাইন প্রতারণার মামলাই ৯৮টি, যা মোট মামলার প্রায় ২৪ দশিমক ১৩ শতাংশ। এরপরেই রয়েছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে (হ্যাক করে) অনলাইনে হয়রানির ঘটনা ৯৭টি (২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ)। এ ছাড়া অনলাইনে মানহানিকর বক্তব্য ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের অভিযোগে ৭৮টি (১৯ দশিমক ২১ শতাংশ) এবং ব্যাংক–মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণার ৭২টি মামলা (১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ) রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য সাইবার অপরাধের অভিযোগে ৬১টি (প্রায় ১৫ দশমিক ০২ শতাংশ) মামলা হয়েছে।
হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশই নারী
ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের (এইচএসসি) এক শিক্ষার্থীর ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে নেয় একটি অপরাধী চক্র। মেয়েটির ছবি সম্পাদনা (এডিট) করে সেটা তার পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে ১০ হাজার টাকা দাবি করে তারা। এই অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সূত্রাপুর থানায় মামলা করেন মেয়েটির মা। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।
এ ঘটনায় বায়তুল ইসলাম ওরফে মুন্না নামের এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করে ডিবি। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবি সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বায়তুল বলেন, তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিশানা করে তাঁদের ফেসবুক নিয়ন্ত্রণে নিতেন। পরে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা দাবি করতেন। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর একটি মুঠোফোন জব্দ করা হয়। মুঠোফোনটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করে অনেক নারীর ছবি, ভিডিও এবং বিভিন্ন পরিবারকে টাকা চেয়ে হুমকি দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, সাইবারজগতে নারী ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে ফেসবুক আইডি হ্যাকিংয়ের ঘটনাই বেশি ঘটে। হ্যাকাররা বিভিন্ন লিংক পাঠিয়ে কৌশলে সেখানে ক্লিক করিয়ে পাসওয়ার্ড জেনে নেয়। এভাবে তারা আইডি হ্যাক করে ছবি, ব্যক্তিগত তথ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে টাকা আদায় করতে এগুলো ব্যবহার করে। এ ছাড়া প্রতারক চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরে তারা নারীদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করে।
ব্যাংক-মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণা
গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে ব্যাংক ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবায় প্রতারণার ঘটনা ঘটছেই। তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতারক চক্র নানা কৌশলে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। এরপর তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পরিচয়ে গ্রাহকদের ফোন করে। তখন কৌশলে ব্যাংক ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাঠানো ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) জেনে টাকা তুলে নেয়। এ ছাড়া ব্যাংকের সার্ভার থেকেও তথ্য হাতিয়ে গ্রাহকের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আসছে।
এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ফারজানা তাসনিনের সঙ্গে। গত ২৫ এপ্রিল তাঁর একাধিক ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের নিয়ন্ত্রণ নেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। তারা কয়েক ধাপে ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা তুলে নেয়। এ ঘটনায় ফারজানা বাদী হয়ে ঢাকার আদাবর থানায় মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, ব্যাংকের কল সেন্টারের কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে আসা ওটিপি জেনে নেন এক প্রতারক। পরে তাঁর টাকা তুলে নেওয়া হয়।
সাইবার অপরাধ নিয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তৌহিদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, দেশে যত সাইবার অপরাধ হয়, তার সব অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেও না। বিচিত্র ধরনের সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ। সামাজিক হেনস্তার ভয়ে অনেক ভুক্তভোগীই অভিযোগ দায়ের না করে চেপে যান। এতে সাইবার অপরাধীরা আরও অপরাধের সুযোগ পায়।
সাইবার অপরাধের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পর্যাপ্ত আইনি সহায়তা দিতে সরকারি উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক তৌহিদ ভূঁইয়া। এ ছাড়া স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলকভাবে সাইবার সুরক্ষাবিষয়ক সচেতনতামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।