প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ঢাকায় আরেকটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি দুই যুগ আগে ঢাকার মিরপুরের মধ্য পীরেরবাগে জনতা রোডে একটি ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। পরে সেই বাড়ির পাশে পৌনে চার কাঠার একটি প্লট কিনে সেখানে সাড়ে ছয়তলা ভবন গড়ে তোলেন তিনি। এ নিয়ে ঢাকায় তাঁর দুটি বহুতল ভবন, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে ডুপ্লেক্স ভবন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার পিএসসির আরেক কর্মচারীর সম্পদ খুঁজতে গিয়ে আজ মঙ্গলবার বিকেলে মধ্য পীরেরবাগে ৩৫/২, জনতা রোডে ‘সৈয়দ রেসিডেন্স’ নামে আবেদ আলীর সাড়ে ছয়তলা ওই বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।
আবেদ আলীর এই বাড়ির পাশের বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম। আজ বিকেলে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে জানান, সৈয়দ আবেদ আলী ২০০১ সালে তাঁর ভবনের নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ভাড়া থাকতেন। প্রথম দিকে সেই ভাড়াও তিনি প্রতি মাসে দিতে পারতেন না। একপর্যায়ে তাঁর বাসায় গভীর রাতে অনেক মানুষের যাতায়াত শুরু হয়। ওই সব লোকজন পরদিন ভোরে চলে যেতেন। এরপর ধীরে ধীরে আবেদ আলীর ভাগ্য বদলাতে থাকে। তিনি ২০১০ সালের দিকে হঠাৎ ৩৫/২ জনতা রোডে পৌনে চার কাঠার প্লট কেনেন। পরের বছর সেখানে সাড়ে ছয়তলার ভবন নির্মাণ করেন। এই বাড়ি করার সময় আবেদ আলী বলেছিলেন, পাইকপাড়ায়ও তিনি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন।
আবেদ আলীর এই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) জুয়েল মিয়া আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ভবনটি সাড়ে ছয়তলাবিশিষ্ট। আবেদ আলী এই বাড়িতে থাকেন না। তিনি পরিবার নিয়ে শেওড়াপাড়ায় তাঁর নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকেন। ভাড়া তুলতেও তিনি এখানে আসেন না। এই ভবনের প্রতিটি তলায় তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এখান থেকে মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে। প্রতি মাসে ওই টাকা তুলে তিনি আবেদ আলীর শেওড়াপাড়ার বাসায় দিয়ে আসেন। তাঁর মালিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, তা তিনি টিভি দেখে জানতে পেরেছেন।
৫ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত অভিযোগে গতকাল সোমবার শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডের ফ্ল্যাট থেকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ২ উপপরিচালক, ১ সহকারী পরিচালকসহ আরও ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ পল্টন থানায় তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে মামলা করেছেন সিআইডির এক কর্মকর্তা। আবেদ আলীর ছেলে সোহানুর রহমান ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক পদে ছিলেন। গতকাল ওই সংগঠন থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, সৈয়দ আবেদ আলী পিএসসিতে গাড়িচালকের চাকরি নিয়েছিলেন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। তাঁর বাড়ি মাদারীপুরে। তবে তিনি ঠিকানা দিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জের। ২০১৪ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পিএসসির চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
আবেদ আলী ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের বাসিন্দা। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবিকার তাগিদে মাত্র আট বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন। প্রথম দিকে ছোটখাটো নানা কাজ করতেন। একপর্যায়ে গাড়ি চালানো শিখে পিএসসিতে চাকরি নেন। তারপর বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। রিয়েল এস্টেটের (আবাসন নির্মাণ) ব্যবসা করে এই সম্পদ অর্জন করেছেন বলে দাবি করতেন তিনি। গ্রামে তাঁর দুই ভাই কৃষিকাজ ও অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
দুই বছর ধরে সৈয়দ আবেদ আলীকে নিজ এলাকায় বেশ সরব দেখছেন বাসিন্দারা। তিনি ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে চান। এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার গরিব-দুঃখীদের দানখয়রাতের পাশাপাশি পোস্টারও সাঁটিয়েছেন। দুই বছর আগে গঠিত ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন।
ডাসার উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ রাকিব হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আবেদ আলী নিজ গ্রামে প্রায় ছয় কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল তিনতলা ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। এ ছাড়া সরকারি জায়গা দখল করে তাঁর গরুর খামার ও বিপণিবিতান নির্মাণের কাজ চলছে। তিনি উপজেলার পান্তাপাড়া ও পূর্ব বোতলা গ্রামে দুই কোটি টাকার বেশি দামের জমি কিনেছেন।
স্থানীয় রাজনীতির মাঠে-ময়দানে দামি গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ করেন সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান (সিয়াম)। বাবা-ছেলে মিলে এলাকায় দুহাত ভরে দানখয়রাত করেন, যার ছবি-ভিডিও ফেসবুকেও দেন তাঁরা।
আবেদ আলীর হঠাৎ এমন উত্থান দেখে রীতিমতো হতবাক ডাসার উপজেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবেদ আলী মূলত ঢাকায় থাকত। শুনেছি, সরকারি গাড়ি চালাত। অনিয়মের কারণে তাঁর চাকরি গেছে। পরে হঠাৎ শুনি, ঢাকার বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যেই এলাকায় এসে গরিব মানুষের মধ্যে টাকাপয়সা বিলাত, খাবার দিত। মানবিক কাজ করে সে সবার কাছে অন্যভাবে পরিচিত হতে চেয়েছিল।’