ফেসবুকে বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপনে বছরে ব্যয় ১৫ কোটি টাকা
রাসেল আহমেদ ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্ম ফাইভারে অ্যাকাউন্ট খুলে কাজ করেন। সেখানে ইউক্রেনের একজন ক্লায়েন্ট (গ্রহীতা) একটি গেমিং প্রজেক্টের জন্য তাঁর একটি ভিডিও চান। তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়, ভিডিও ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং মোবাইল গেমিং কোম্পানিকে দেখানোর উদ্দেশ্যেই এটি চান তিনি।
বাংলাদেশি এ ফ্রিল্যান্সার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর সেই ভিডিও ফেসবুকে জুয়া–সম্পর্কিত অ্যাপের প্রচারণায় দেখতে পান।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে রাসেল আহমেদের এ অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার ডিসমিসল্যাব ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মেটা হচ্ছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) গত বছরের জুলাইতে নিউজ পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশনসহ জুয়ার বিজ্ঞাপন দৃশ্যমান হয়, এমন সব ওয়েবসাইট ব্লক করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
কিন্তু অনলাইন বেটিং বা জুয়ার প্রচারণা থেমে নেই। ডিসমিসল্যাব মাত্র এক দিনেই মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে কয়েক হাজার সক্রিয় জুয়ার বিজ্ঞাপনের খোঁজ পেয়েছে; যা বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে ও হাজার হাজার ডলার খরচে প্রচার হচ্ছে। বিজ্ঞাপনগুলোতে বোর্ড গেমস, স্লট, ক্যাসিনো, স্পোর্টস বেটিংয়ের প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ আয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা গত ৩০ মার্চ মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে নির্দিষ্ট কিছু ‘কি–ওয়ার্ড’ দিয়ে সার্চ দেন। তাতে চার হাজারের বেশি জুয়ার বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। এ ছাড়া ‘জ্যাকপট’ ও ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ কি–ওয়ার্ড ব্যবহার করেও এ লাইব্রেরিতে সার্চে জুয়ার শত শত সক্রিয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়।
ডিসমিসল্যাব এসব বিজ্ঞাপন নিয়ে বেশ কিছু উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরেছে; যেমন বিজ্ঞাপনদাতার সফলভাবে মেটার নীতি লঙ্ঘন ও এখান থেকে মেটার নিজেরই মুনাফা করা। মানুষকে প্রলুব্ধ করতে বিজ্ঞাপনে প্রায়ই তারকা খেলোয়াড় ও অভিনয়শিল্পীদের স্থির ছবি এবং ভিডিও ব্যবহার। আবার এসব বিজ্ঞাপনে কিছু অ্যাপ দেখানো হয়, প্রাথমিকভাবে যেগুলো মনে হবে গুগল প্লে স্টোরে থাকা নিরীহ কোনো গেমের। কিন্তু এগুলো তাদের ব্যবহারকারীদের অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায়।
অনলাইন জুয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গত মাসে বিটিআরসির সচিব মো. নূরুল হাফিজ প্রথম আলোকে বলেন, জুয়ার সাইটগুলো বন্ধে বিটিআরসির একটি ইউনিট নিয়মিত কাজ করছে। সাইটগুলোর বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
জুয়ার বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি
ডিসমিসল্যাবের গবেষকেরা গত ৩০ মার্চ মেটার অ্যাড লাইব্রেরিতে নির্দিষ্ট কিছু ‘কি–ওয়ার্ড’ দিয়ে সার্চ দেন। তাতে চার হাজারের বেশি জুয়ার বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়। এ ছাড়া ‘জ্যাকপট’ ও ‘অনলাইন ক্যাসিনো’ কি–ওয়ার্ড ব্যবহার করেও এ লাইব্রেরিতে সার্চে জুয়ার শত শত সক্রিয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়।
ডিসমিসল্যাব বলছে, তাঁদের এসব সার্চ বাংলায় ছিল। তবে ইংরেজিতে সার্চ করলে বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপনের সংখ্যা আরও বেশি হবে। এর বাইরে কোনো ক্যাপশন ছাড়া রয়েছে অনেক বিজ্ঞাপন। অনেক বিজ্ঞাপন কয়েক মাস থেকে শুরু করে এক বছর ধরে সক্রিয়।
জুয়ার সাইটগুলো বন্ধে বিটিআরসির একটি ইউনিট নিয়মিত কাজ করছে। সাইটগুলোর বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপনগুলোর ধরন বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব বলছে, বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন ‘বিডি’ দিয়ে শুরু ও শেষ হয়। বাক্য থাকে অসম্পূর্ণ। অর্থাৎ অনলাইনের সহায়তায় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে এগুলো দেখানো হয়। এ ছাড়া ব্যবহার করা হয় একই বার্তা ও ভিডিও। বিজ্ঞাপনগুলোর সব উৎস বের করা যায়নি। তবে অন্তত ৫০টি পেজের অ্যাডমিনরা ইউক্রেন, জার্মানি, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক।
তবে কিছু পেজের বাংলাদেশি অ্যাডমিন রয়েছে; যারা বেশির ভাগ খেলাবিষয়ক জুয়ার প্রচারণা করে। এ বিষয়ে ডিসমিসল্যাব ‘গ্লোরি ক্যাসিনো’ ও ‘ক্রেজি টাইম’ নামের দুটি প্ল্যাটফর্মের কথা উল্লেখ করেছে।
বিজ্ঞাপনে ব্যয়
ডিসমিসল্যাব বলছে, ফেসবুকে বা মেটার অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে জুয়ার বিজ্ঞাপনের সঠিক ব্যয় বলা কঠিন। তবে তারা কিছু তথ্য–উপাত্ত থেকে একটি ধারণামূলক হিসাব বের করেছে।
মেটার হিসাবে বিজ্ঞাপনদাতাদের ‘ইম্প্রেশনের’ (প্রভাব) জন্য প্রতিদিন অন্তত এক ডলার করে হলেও বরাদ্দ রাখতে হয়। সর্বনিম্ন বিজ্ঞাপন ব্যয় প্রতিদিন ১ ডলার বিবেচনা করা হলেও বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের লক্ষ্য করে প্রায় ৪ হাজার ডলারের জুয়ার বিজ্ঞাপন মেটার প্ল্যাটফর্মে দেওয়া হয়। এতে শুধু মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোতেই বছরে বিজ্ঞাপনে ব্যয় আনুমানিক অন্তত ১৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে বলে ডিসমিসল্যাব বলছে।
এ ছাড়া ছুটি, উৎসব বা বিভিন্ন খেলার আয়োজনের সময়ে বিজ্ঞাপনের ব্যয়ে হেরফের হতে পারে। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) চলাকালে জুয়াড়িরা বেশ সক্রিয় থাকেন, যেমন ‘আইপিএল ২০২৪’ লিখে সার্চ দিলে জুয়ার নানা বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়।
প্রচারণায় তারকাদের ভুয়া ছবি ও ভিডিও
জুয়ার প্রচারণায় তারকা ক্রিকেটারদের বিভিন্ন সময়ের ভিডিও এবং স্থির ছবি সম্পাদনা করে ব্যবহার করা হচ্ছে। অ্যাড লাইব্রেরিতে প্রায় ৫০টি বিজ্ঞাপন বের করেছে ডিসমিসল্যাব; যেখানে তারকাদের ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে। এসব প্রচারণায় বাংলাদেশি ক্রিকেট তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন সাকিব আল হাসান।
উদাহরণ হিসেবে ডিসমিস ল্যাব বলছে, সাকিবের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি পোশাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত ছবি সম্পাদনা করে ‘গ্লোরি ক্যাসিনো’র বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সাকিবের একটি আসবাবপত্রের বিজ্ঞাপনের ভিডিও বার্তা পরিবর্তন করে জুয়ার প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়েছে।
এ ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) কিংবা ডিপফেক টুলের মাধ্যমে সাকিব আল হাসানসহ মাশরাফি বিন মুর্তজা, মোস্তাফিজুর রহমান ও তামিম ইকবালের মতো খেলোয়াড়দের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনগুলোতে; যদিও ফেসবুকের নীতি অনুযায়ী এ ধরনের কনটেন্ট (আধেয়) সরিয়ে ফেলার কথা।
তারকাদের ছবি–ভিডিও ছাড়াও দেশের প্রতিষ্ঠিত টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর লোগোও ব্যবহার করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনে। আবার বিজ্ঞাপনদাতারা তাঁদের প্রচারের ক্ষেত্রে সম্প্রচার করা সত্যিকার সংবাদের ভিডিও পরিবর্তন করছেন।
ডিসমিস ল্যাব দেখতে চেয়েছে এসব বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীদের কোথায় টেনে নিয়ে যায়। এ জন্য তারা বিজ্ঞাপনের লিংক থেকে পাওয়া ছয়টি অ্যাপ এবং দুটি হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামে গ্রুপ যাচাই করে। দেখা যায়, ম্যাসেজিং গ্রুপগুলোতে জুয়ার সাইটের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। পাঁচটি অ্যাপ ডাউনলোড করা গেলেও ক্ষতিকর চিহ্নিত করে একটি অ্যাপকে ফোনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইনস্টল করতে দেয়নি। ডাউনলোড করা অ্যাপগুলো দেখে মনে হয় সাধারণ মোবাইল গেম, কিন্তু ওপেন করার পর সেগুলো একপর্যায়ে গ্লোরি ক্যাসিনো ও পিন আপের মতো জুয়ার প্ল্যাটফর্মে নিয়ে যায়।
জুয়ার বিজ্ঞাপন ধরতে পারছে না মেটা
মেটার জুয়া খেলা–সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন নীতিতে বলা আছে, সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে যেসব অ্যাপ রয়েছে সেগুলো তারা ব্যতিক্রম হিসেবে ধরে। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতারা আপাতদৃষ্টে বিনা মূল্যের গেমিং অ্যাপের সঙ্গে নীতি লঙ্ঘন করে টাকা দিয়ে খেলার প্রচারণাও চালাচ্ছে। মেটার স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বিজ্ঞাপনগুলোকে জুয়াসংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ।
এ ছাড়া মেটার অনলাইন জুয়া ও গেমিং বিজ্ঞাপন নীতিমালায় বলা আছে, বিজ্ঞাপনদাতারা এ ধরনের প্রচারের আগে অবশ্যই একটি ফরম পূরণ করতে হবে এবং যেসব দেশ মেটার তালিকাভুক্ত, সেসব দেশকেই লক্ষ্য করে বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে।
কিন্তু মেটার অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের জন্য অনুমোদিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। ডিসমিসল্যাব বলছে, এসব বিজ্ঞাপনদাতা তাদের বিজ্ঞাপনের ধরন অস্পষ্ট করে বা মেটার শনাক্তকরণ পদ্ধতি এড়িয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মেটার নীতি লঙ্ঘন করা সত্ত্বেও যেহেতু বিজ্ঞাপনগুলো চলছে; তাতে মনে হচ্ছে, তাদের (মেটা) এআই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এসব বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। এই জুয়ার বিষয়ে সরকারকে মেটার সঙ্গে আলোচনায় যেতে হবে। পাশাপাশি মানুষকেও সচেতন করতে হবে, কারণ তারাও এসবের ভুক্তভোগী হচ্ছেন।