বেপরোয়া ২৩৭ ‘কিশোর গ্যাং’

সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ‘কিশোর গ্যাং’-এর সদস্যরা।

ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখল, নারীদের উত্ত্যক্ত করা—দেশের যেকোনো এলাকায় এখন এ ধরনের অপরাধ ঘটলে ‘কিশোর গ্যাং’-এর নাম আসছে। অথচ এক যুগ আগেও পাড়া-মহল্লাকেন্দ্রিক অপরাধের ঘটনায় নাম আসত কোনো না কোনো সন্ত্রাসী বাহিনীর। এখন সে জায়গা ‘দখল’ করেছে কথিত কিশোর গ্যাং। যদিও এসব বাহিনীর সদস্যদের বেশির ভাগই ১৮ বছরের বেশি বয়সী।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা গত এপ্রিল মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথিত কিশোর গ্যাংদের তৎপরতা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এখন সারা দেশে ২৩৭টির মতো ‘কিশোর গ্যাং’ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকা শহরে, ১২৭টি। এসব গ্যাংয়ের (অপরাধী দল) সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। ঢাকার পর চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি। এসব দলের সঙ্গে জড়িত ৩১৬ জন।

কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা বা চট্টগ্রাম নয়, গাজীপুর ও খুলনা মহানগর এলাকায়ও বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাং চক্র গড়ে উঠছে; যারা খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষ-মারামারিতে জড়াচ্ছে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। জেলা শহরগুলোতেও কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বাড়ছে। যেমন গত ১৮ এপ্রিল নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায় কথিত কিশোর গ্যাং ‘এফ টেন’-এর সদস্যরা নিজেরাই বিরোধে জড়ায়। বৈশাখী মেলায় দোকান বসানো নিয়ে নিজেদের বিরোধ থেকে ১৮ বছর বয়সী এক তরুণকে (গ্যাংয়ের সদস্য) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি নোয়াখালী সদর উপজেলায় কথিত কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ২০ বছর বয়সী এক তরুণ খুন হন। মূলত এলাকায় কোন গ্যাংয়ের প্রভাব বেশি থাকবে—এ নিয়ে দুই পক্ষে বিরোধ দেখা দেয়। স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা তখন এমনটি বলেছিলেন।

নোয়াখালীর ওই দুটি ঘটনার পর কথিত কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। তখন পুলিশ বলেছিল, তদন্তে ইন্ধনদাতাদের নাম এলে গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু দুটি খুনের ঘটনায় গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য ছাড়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী (ইন্ধনদাতা হিসেবে নাম আসা) কাউকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।

কিশোর গ্যাং সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা (পৃষ্ঠপোষকেরা)। কিশোর গ্যাংয়ের মদদদাতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের তথা নেপথ্যের শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিষয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় ‘কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দেন ঢাকার ২১ কাউন্সিলর’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, কিশোর গ্যাংগুলো এক দিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মানুষের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে গ্যাংগুলো।

কিশোর গ্যাং সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা গ্রেপ্তার হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা (পৃষ্ঠপোষকেরা)।

প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে পুলিশের নিজস্ব অনুসন্ধানের কিছু তথ্য ব্যবহার করা হয়। এতে বলা হয়, ২০২২ সালের শেষ দিকে কিশোর গ্যাং নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতে রয়েছে ৬৬টি, চট্টগ্রাম শহরে ৫৭টি।

তবে গত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণের পর দেখা যাচ্ছে, গত দেড় বছরে শুধু ঢাকাতেই কিশোর গ্যাং বেড়েছে ৬১টি। এখন আছে ১২৭টি। একইভাবে সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৬৪টি বেড়ে হয়েছে ২৩৭।

ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে, তার ২৫টি কিশোর গ্যাং-সংশ্লিষ্ট। এর অর্থ হচ্ছে, বিভিন্ন গ্যাংয়ের সদস্যরা নিজ এলাকায় প্রভাব বাড়াতে এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ দ্বন্দ্বের জেরে জামাল হোসেন নামের এক তরুণকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার নেপথ্যেও কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষ বলে পুলিশ জানিয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামে গত ৫ এপ্রিল কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাত থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে হামলায় গুরুতর আহত হন দন্তচিকিৎসক কোরবান আলী। ঘটনার পাঁচ দিন পর হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

এ ঘটনার পর গত ১৬ এপ্রিল জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা যেভাবে বেড়েছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে নিরীহ মানুষ, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না।

এর আগে গত ২২ মার্চ প্রথম আলোয় ‘৫ কাউন্সিলরসহ ৬৪ “বড় ভাইয়ের” প্রশ্রয়ে চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে পুলিশের তথ্য দিয়ে বলা হয়, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। সর্বশেষ ১০ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিয়ে প্রথম আলোয় ‘জুলো বাহিনীর নাম নিতেও ভয়’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জুলোর পুরো নাম পার্থ চৌধুরী ওরফে মহসিন চৌধুরী ওরফে জুলো। চট্টগ্রামের পটিয়ায় সবাই তাঁকে চেনে কথিত কিশোর গ্যাং নেতা ‘জুলো বাহিনীর’ প্রধান হিসেবে। এ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৫০। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ডাকাতি, জায়গা দখল, নারী উত্ত্যক্তকরণসহ নানা অপরাধে জড়িত এই বাহিনী।

মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে ইত্যাদি।

‘চটকদার নামে কিশোর গ্যাং’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, একই পাড়া-মহল্লার বাসিন্দা অথবা বখে যাওয়া কিশোর-তরুণেরা এক জোট হয়ে বাহারি ও চটকদার নামে কিশোর গ্যাং তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওই নামে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ‘আইডি’ খোলা হয়। যেমন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে ফিল্ম ঝিরঝির, স্টার বন্ড, গ্রুপ টোয়েন্টি ফাইভ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, কোপাইয়া দে ইত্যাদি।

 প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান এবং ত্রি গোল। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং।

ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড নামের কিশোর গ্যাং রয়েছে। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় অদ্ভুত সব নামে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করছে বলে পুলিশ সূত্রগুলো বলছে।

ধানমন্ডিতে একে ৪৭, নাইন এম এম ও ফাইভ স্টার বন্ড নামের কিশোর গ্যাং রয়েছে। বংশালে রয়েছে জুম্মন গ্যাং, তেজগাঁওয়ে মাঈনুদ্দিন গ্যাং, মুগদায় চান জাদু, ডেভিড কিং ফল পার্টি, ভলিয়ম টু ও ভান্ডারি।

যেভাবে শুরু

রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে স্কুলছাত্র আদনান কবিরকে সমবয়সী কিশোরেরা খেলার মাঠে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। মূলত এরপরই কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতার বিষয়টি প্রথম সবার নজরে আসে।

এ ঘটনার পর র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার গ্রুপ’-এর আটজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। আসামিরা জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আদনানের পরিবারকে হুমকি দিতে থাকে। যে কারণে তার পরিবার উত্তরা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।

কিশোর গ্যাং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি জানা যায় ২০১৯ সালে। ওই বছরের জুন মাসে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও তখন সারা দেশে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়েছিল। রিফাত হত্যার পর জানা যায়, বরগুনা শহরে ‘০০৭’ নামে একটি গ্যাং রয়েছে। ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে এর সদস্য ছিল ১০৬ জন। গ্যাংয়ের প্রধান ছিলেন সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড। রিফাত হত্যার পর দেশজুড়ে আলোচনায় আসে নয়ন বন্ড ও তাঁর ০০৭ গ্রুপের নাম। রিফাত হত্যাকাণ্ডের পর ওই বছরের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নয়ন।

উত্তরা এলাকার গ্যাংগুলোর মধ্যে রয়েছে নাইন স্টার, পাওয়ার বয়েজ, বিল বস, নাইন এম এম বয়েজ, সুজন ফাইটার, ক্যাসল বয়েজ, আলতাফ জিরো, ভাইপার, তুফান এবং ত্রি গোল। মিরপুর এলাকায় আছে সুমন গ্যাং, পিচ্চি বাবু, বিহারী রাসেল, বিচ্চু বাহিনী, সাইফুল গ্যাং, বাবু রাজন, রিপন গ্যাং, সাব্বির গ্যাং, নয়ন গ্যাং এবং মোবারক গ্যাং।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হিরোইজমের’ চিন্তাভাবনা থেকে কিশোরদের মধ্যে ‘গ্যাং’ কালচার শুরু হলেও তারা এখন ভয়ংকর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক দলের বড় ভাইদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ার ফলে কিশোরেরা নিজেদের ‘পাওয়ারফুল’ (ক্ষমতাবান) মনে করে এবং সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

 কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রোধে ২৩ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন থানার ওসিদের নির্দেশনা দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান। সেদিন ডিএমপির মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় তিনি বলেন, যে ওসির থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে, তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মন্ত্রিসভায় আলোচনা

মন্ত্রিসভার ৮ এপ্রিলের বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীদের মোকাবিলার জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রথাগত অন্য অপরাধীদের সঙ্গে যেন তাদের (কিশোর অপরাধী) মিলিয়ে ফেলা না হয়। তাদের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা—এ ধরনের সুযোগ-সুবিধাগুলো যেন রাখা হয়।

মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে কিশোর অপরাধীদের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টি দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, তাদের (কিশোর অপরাধী) যেন দীর্ঘ মেয়াদে অপরাধী বানিয়ে ফেলা না হয়, সংশোধনের সুযোগ যেন থাকে। কারাগারে অন্য আসামিদের সঙ্গে যেন না রাখা হয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে বলে প্রথম আলোকে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। ১৩ মে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলা পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি, যেন তাঁরা এ বিষয়ে সতর্ক থাকেন। তবে কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

নিয়ন্ত্রণে যেসব সুপারিশ

কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শুধু জিপিএ-৫ পাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সন্তানদের ব্যস্ত না রেখে পড়ালেখার বাইরেও খেলাধুলা, নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, স্কাউটিংয়ের মতো সুস্থ বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তাদের আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করা। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) প্রবেশ নিশ্চিত করা এবং কিশোরদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে—এমন অ্যাপগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করে দেওয়া।

পাড়া-মহল্লাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রাখা এবং কিশোর গ্যাংয়ের ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া। জুমার নামাজে খুতবায় কিশোর গ্যাংয়ের কুফল এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে নিয়মিত বয়ানের পদক্ষেপ নেওয়া।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, কিশোর সংশোধনাগারের পরিবেশ শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সহায়ক হওয়া। সংশোধনাগারে যেন মানসিক নির্যাতন ও টর্চার সেলে পরিণত না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখা। আরও বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মোটরসাইকেল রেস (গতির লড়াই) করে, এ বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিশোর গ্যাং সৃষ্টির কারণ ও উত্তরণের উপায় নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে গবেষণা করা প্রয়োজন।

অপরাধমূলক ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কা

ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্যাংয়ের সদস্যরা কখনো রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অবস্থান করে বা সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, ধর্ষণ, অস্ত্র ব্যবসা, পাড়া-মহল্লার নারী ও কিশোরীদের উত্ত্যক্ত করা এবং খুনের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িয়ে পড়ছে। তাদের এসব কর্মকাণ্ড সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে খুনসহ বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিশোর অপরাধের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্য ছিনতাই, ছাত্রী অপহরণ ও স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা অ্যাসিড নিক্ষেপের আশঙ্কায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

কিশোর গ্যাং বেপরোয়া হয়ে ওঠা ও তাদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যারা গ্যাং তৈরি করছে এবং নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে অপরাধ করাচ্ছে, তারা আইনের মুখোমুখি হওয়া থেকে দূরেই থাকছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে পেছনের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসন এবং দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি জোরালোভাবে প্রয়োগ করলে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। তবে কিশোর অপরাধের মাত্রা যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কিশোর কারাগার-ব্যবস্থা চালু করা, কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোকে সময়োপযোগী পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সংশোধন কার্যক্রম পরিচালনায় সক্ষম করে গড়ে তোলা।

রাজনৈতিক শক্তি ও পরিচয় ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ব্যতীত কিশোর গ্যাং সমস্যার সমাধান হবে না বলে মনে করেন অপরাধবিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, একটি বিষয় খুব স্পষ্ট যে গ্যাং সদস্যদের ব্যবহার করে কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করছে ও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এই লাভের ক্ষেত্র বন্ধ করা এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে না পারলে এখান থেকে সহজেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।