সোনা পাচার করে বাড়ি–গাড়ি
দুবাই থেকে সোনা এনে ভারতে পাচার করতেন তাঁরা। আদালতের নির্দেশে সম্পদ জব্দ করেছে সিআইডি।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে দাউদকান্দি উপজেলা। সেখান থেকে গ্রামীণ সড়ক ধরে আরও ছয় কিলোমিটার গেলে পাঁচগাছিয়া পশ্চিম ইউনিয়নের নলচক গ্রাম। গ্রামটিতে বেশির ভাগ বাড়ি টিনের ছাউনির। তবে ব্যবসায়ী ও প্রবাসীরা কেউ কেউ পাকা ভবন করেছেন।
এই গ্রামে নির্মাণকাজ চলতে থাকা একটি ভবন এখন মানুষের আগ্রহের কারণ। সেটি নির্মাণ করছেন মোহাম্মদ আনিছুর রহমান (৩৭), যিনি একসময় ছিলেন গাড়িচালক। তাঁর পরিবারও ছিল অসচ্ছল।
আনিছুর কীভাবে বেশ ভালো দাম দিয়ে জমি কিনলেন এবং সেই জমিতে দারুণ নকশা করে বাড়ি করছেন, সেটা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে বিস্ময়কর লাগছে। গ্রামের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আনিছুরের বাবার বসতভিটা ছাড়া কোনো জমি ছিল না। অভাবে পড়ে সেই ভিটাও তিনি বিক্রি করে দেন। গাড়ি চালিয়ে তাঁর ছেলে কীভাবে এত সুন্দর বাড়ি করছেন, এটা রহস্যজনক।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেড় বছরের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, আনিছুর আসলে অনেক আগে গাড়ি চালকের পেশা ছেড়ে সোনা চোরাচালান শুরু করেছেন। অপরাধ থেকে আয়ের মাধ্যমেই তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। অর্থ পাচারের মামলায় আনিছুর এখন পলাতক।
আনিছুর যে সোনা চোরাচালানকারী চক্রের সদস্য, সেই চক্রের ১২ জনের নাম, ঠিকানা এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে সিআইডি। কর্মকর্তারা বলছেন, চোরাচালানের টাকা দিয়ে কেউ করেছেন বাড়ি, কেউ কিনেছেন গাড়ি, কেউ বানিয়েছেন বিপণিবিতান, কেউ আবার গরুর খামার করেছেন। তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি টাকার সম্পদের হদিস পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সোনা চোরাচালানকারীদের খোঁজ পাওয়া সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। তাঁদের আরও সম্পদ রয়েছে। তার খোঁজ চলছে।
সম্পদের খোঁজে
সিআইডির অনুসন্ধান শুরু হয় ২০২২ সালে। ওই বছর জুনে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচারের সময় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি। কর্মকর্তারা বলছেন, চক্রের দুই হোতা হলেন বেনাপোলের নাসিরুদ্দিন (৪০) ও রমজান আলী (২৯)।
সিআইডি গত বছরের জুনে রমজান ও নাসিরুদ্দিন এবং তাঁদের ১০ সহযোগীকে আসামি করে যশোরের কোতোয়ালি থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করে। আদালতে গত রোববার চক্রটির সদস্যদের অবৈধ সম্পদ ও ৪৬টি ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন করা হয়। আদালত সোমবার সম্পদ জব্দের আদেশ দেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চক্রের মূল হোতা নাসিরুদ্দিন, তাঁর স্ত্রী মোছা. বিলকিচ খাতুন, মো. সেলিম হোসেন ও নাজমুল হোসেন কারাগারে রয়েছেন। আরেক হোতা মো. রমজান আলী এবং তাঁর সহযোগী মো. ওলিয়ার রহমান, রেজাউল করিম, রুহুল আমীন ও মোহাম্মদ আনিসুর রহমান পলাতক।
রমজান ও নাসিরুদ্দিনের বাড়ি যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী পুটখালী গ্রামে। সেই গ্রামে গতকাল সকালে গিয়ে পাওয়া যায় একটি বড় গরুর খামার, যার মালিক নাসিরুদ্দিন। খামারে ঢুকতেই পাঁচ-ছয়জন যুবক প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ঘিরে ধরেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁরা জেরা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেলে করে আরও কিছু লোক খামারে আসেন। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর গাড়িতে আসেন চার ব্যক্তি। একপর্যায়ে এক ব্যক্তি মুঠোফোনে খামারের পরিচালক দাবি করা ওলিয়ার রহমানের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন।
ওলিয়ার রহমান পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ও তাঁর ভাই নাসিরুদ্দিন গরুর ব্যবসা করেন। নাসিরুদ্দিন একটি মামলায় কারাগারে রয়েছেন। তাঁদের প্রতিপক্ষরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে এই মামলা করেছেন।
কৌশলে খামার থেকে বেরিয়ে এসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাসিরুদ্দিন একসময় গরু চোরাচালান করতেন। তবে ভারত বাংলাদেশে গরু চোরাচালানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের পর তিনি সোনা, অস্ত্র ও বৈদেশিক মুদ্রা চোরাচালান শুরু করেন। সিআইডি দলিলপত্র পর্যালোচনা করে বলছে, নাসিরুদ্দিনের সাড়ে পাঁচ কোটির টাকার সম্পদ রয়েছে।
পুটখালীতেই বাড়ি রমজান আলীর। তবে স্থানীয় লোকজন জানান, তাঁরা গ্রামে থাকেন না। থাকেন বেনাপোলে। সেখানে রমজান ও তাঁর ভাই সেলিমের দোকান রয়েছে। বেলা দুইটার দিকে দোকানে গিয়ে এক কর্মচারীকে পাওয়া যায়। তিনি একজনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন, যিনি নিজেকে দোকানের ব্যবস্থাপক পরিচয় দেন। ওই ব্যক্তি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রমজান কোথায়, তা তিনি জানেন না। মুঠোফোন নম্বর দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, ‘মামলার বিষয়ে তাঁদের (রমজান) চিন্তা আছে। আপনার চিন্তা করার দরকার নেই।’
সিআইডি জানিয়েছে, তারা রমজানের জমি, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে।
দুবাই থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে
সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাই থেকেই বেশির ভাগ সোনা বাংলাদেশে আসে। সিআইডি বলছে, পরে তার বড় অংশ পাচার হয় ভারতে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গত তিন মাসে প্রায় ৭৩ কেজি ওজনের সোনার বার জব্দ করা হয়েছে, যার দাম ৬৬ কোটি টাকা।
ভারতে সোনার বিপুল চাহিদা রয়েছে। বৈধ আমদানির পাশাপাশি সোনা দেশটিতে অবৈধ পথে যায়, যার একটি রুট (পথ) হিসেবে গণ্য করা হয় বাংলাদেশকে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মাসুদ আলম, যশোর ও আবদুর রহমান ঢালী, দাউদকান্দি, কুমিল্লা]