সিআইডি কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে দেড় কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় ডিবি কর্মকর্তার
সিআইডির এসআই আকসাদুদকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
‘১ কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই। আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?’ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই টেলিফোন কথোপকথনের সত্যতা পাওয়া গেছে। ঘুষ লেনদেনের এই ঘটনা ঘটেছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক কর্মকর্তার মধ্যে। ওই টেলিফোন আলাপচারিতায় ছিলেন বর্তমানে সিআইডির চাকরিচ্যুত উপপরিদর্শক (এসআই) আকসাদুদ জামানের স্ত্রী তাহমিনা ইয়াসমিন এবং ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কায়সার রিজভী কোরায়েশি। প্রায় এক বছর তদন্ত করে এ ঘটনার সত্যতা পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফৌজিয়া খানের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি গত ২৬ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সিআইডির এসআই আকসাদুদ জামানকে মালিবাগ থেকে উঠিয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক মুক্তিপণ বাবদ ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আদায় করার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ডিবির সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে তদন্ত কমিটি।
তবে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার চার মাস পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও পরিচালন) কামরুল আহসান ২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধের ধরন অনুযায়ী কায়সার রিজভীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি ছাড়া অভিযুক্ত অন্যরা হলেন ডিবির পরিদর্শক জাহিদুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান, এসআই মাসুদুল ইসলাম, এএসআই প্রকাশ চন্দ্র গুহ ও জুলহাস এবং কনস্টেবল মাসুদ রানা। তাঁদের কারও বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কায়সার রিজভীকে সম্প্রতি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদর দপ্তরে বদলি করা হয়েছে। তবে তিনি এখনো ডিবিতে কর্মরত আছেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনা সম্পর্কে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করলে এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি এ নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ডিবির অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী সাবেক এসআই আকসাদুদ জামানও তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারেন। এ ছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
যেভাবে মুক্তিপণ আদায়
২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের কবলে পড়েন দুবাইপ্রবাসী রোমান মিয়া। ফুফাতো ভাই মো. মনির হোসেনকে নিয়ে তিনি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে যাচ্ছিলেন। কাওলা পদচারী–সেতুর কাছে মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল দিয়ে তাঁদের পথ আটকানো হয়। মনিরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে ডিবি পরিচয় দিয়ে রোমান মিয়াকে মাইক্রোবাসে তুলে নেন দুর্বৃত্তরা। তাঁর হাতে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার ও দুই হাজার দিরহাম (সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা) ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে রামপুরা এলাকায় ফেলে যান দুর্বৃত্তরা। পরদিন এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন রোমান। ওই মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। মামলার তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা ছিলেন এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়েশি।
ডিবি সূত্র বলছে, তদন্তে প্রবাসী রোমান মিয়াকে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া ও ডাকাতির ঘটনায় এসআই আকসাদুদ জামানসহ নয়জন জড়িত থাকার তথ্য–প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
এসআই আকসাদুদ জামান ওই সময় সিআইডিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং–এর মাধ্যমে প্রতারণার একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তিনি মাদারীপুর–শরীয়তপুরভিত্তিক একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সন্ধান পান। এই চক্র হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করছে বলে তিনি জানতে পারেন। তখন সিআইডি থেকে তাঁকে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে তদন্ত করার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর খোঁজ নিয়ে রোমান মিয়ার বিষয়ে জানতে পারেন। আকসাদুদের অভিযোগ, রোমান মিয়ার সঙ্গে কায়সার রিজভীর পূর্বপরিচয় থাকায় মামলাটি তদন্তের ভার ডিবিতে নিয়ে আসেন তিনি। কায়সার রিজভী তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) উত্তরা বিভাগের বিমানবন্দর জোনাল টিমে ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুদকে তুলে নেওয়া ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। সেটা অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সকালে আকসাদুদ সিআইডি কার্যালয়ে যাওয়ার পথে মালিবাগ মোড়ে পৌঁছালে তাঁকে কায়সার রিজভীসহ তাঁর দলের সদস্যরা আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে তাঁকে বলা হয়, কাওলায় প্রবাসী রোমান মিয়ার অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আরও পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁরা এ ঘটনায় আকসাদুদের নাম বলেছেন। একপর্যায়ে অভিযোগ থেকে তাঁদের রেহাই দেওয়া নিয়ে কথা হয়। কায়সার রিজভী কোরায়েশি দুই কোটি টাকা চান। এ সময় কায়সার রিজভীর ফোন দিয়ে হোয়াটসআ্যাপে আকসাদুদ তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। পরে আটক ব্যক্তিদের সবাইকে মুঠোফোনে তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়। কথামতো সবাই আকসাদুদের বাসায় টাকা রেখে যান। আকসাদুদ দিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা, আর বাকি ৫ জন দেন ৯৫ লাখ টাকা। ওই দিন সন্ধ্যার পর আকসাদুদকে সঙ্গে নিয়ে খিলগাঁও ঝিলপাড় এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়ে ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা নিয়ে আসেন কায়সার রিজভীসহ তাঁর টিমের সদস্যরা। তখন আকসাদুদকে আবার ডিবি অফিসে আনা হয়। পরে তাঁর স্ত্রী কায়সার রিজভীকে আরও ১৪ লাখ টাকা দেন। এরপর ২৮ নভেম্বর আকসাদুদ ছাড়া পান।
তবে মামলা চলতে থাকে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হাসান রাজা। তিনি পরবর্তী সময়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে রোমান মিয়াকে তুলে নিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আকসাদুদও জড়িত বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ ঘটনায় ডিবির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট আকসাদুদ জামানকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিআইডি। এর কয়েক দিনের মাথায় ৩১ আগস্ট কায়সার রিজভী কোরায়েশিসহ ডিবির ওই সাত সদস্যের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন আকসাদুদ। এর সপ্তাহ না যেতেই ৮ সেপ্টেম্বর আকসাদুদের স্ত্রীর সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভীর ‘মুক্তিপণ’ লেনদেনের টেলিফোন কথোপকথনের অডিও ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন রাতে রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে আকসাদুদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। পরে তাঁকে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। আকসাদুদ বর্তমানে ওই মামলায় জামিনে আছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরও এ ঘটনা তদন্তে ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আতাউল কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করে ওই প্রতিবেদন অন্তত চার মাস আগে জমা দিয়েছেন তিনি।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেছেন, প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে কাজ চলছে।
আকসাদুদের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত
প্রবাসী রোমান মিয়ার করা ডাকাতির মামলায় গত বছরের ২২ মে আকসাদুদ জামানসহ নয়জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি। অভিযোগপত্রভুক্ত অন্যরা হলেন সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন, রিজু মিয়া সিকদার, হাসান রাজা, মিলন মোড়ল, মনির হোসেন ও স্টেশনারি ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলেছে, মামলা হওয়ার দীর্ঘ ১১ মাস পর (২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর) আকসাদুদকে রংপুর থেকে গ্রেপ্তার ও মামলায় ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস জব্দ দেখানো হয়েছে। এই মামলায় আটক করা মাইক্রোবাসের চালক হারুন অর রশীদ ওরফে সজীবের লগবই যাচাই ও তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে। এ জন্য ডিবির সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া ডাকাতির মামলায় আকসাদুদ জামানের সম্পৃক্ততা কী, তা অধিকতর তদন্ত করে যাচাই–বাছাই করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ডিবির সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আইনের লঙ্ঘন হবে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কায়সার রিজভীসহ সাত পুলিশ সদস্য ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। ফৌজদারি আইনে সবাই সমান অপরাধী।