জামিনে ছাড়া পেয়েই অপরাধে জড়িত, কিশোরকে অপহরণ

কিশোর গ্যাংপ্রতীকী ছবি

৮-১০ জন সহযোগী নিয়ে অস্ত্রসহ চলাফেরা করেন। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধরের মতো অপরাধ করে বেড়ান নিয়মিতই। নাম তাঁর হেলাল বাদশা চৌধুরী। বয়স ২৫ হলেও কিশোর গ্যাং নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। চট্টগ্রাম নগরের অভিজাত জিইসি এলাকায় ছিনতাই ও ফুটপাতের বিভিন্ন দোকানে এই দলের চাঁদাবাজিতে মানুষ অতিষ্ঠ। পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মারামারির একটি মামলায় ১০ মে গ্রেপ্তার হয়ে ওই দিনই আদালত থেকে জামিন পান বাদশা। ছাড়া পেয়ে আবারও অপরাধে জড়ান। গত শুক্রবার (১৭ মে) রাতে মুঠোফোন ছিনতাই করতে না পেরে এক কিশোরকে অপহরণ করেন। দাবি করা হয় এক লাখ টাকা মুক্তিপণ। পুলিশ শুক্রবার রাতেই অস্ত্র, সাত সহযোগীসহ কিশোর গ্যাং নেতা হেলাল বাদশা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে নগরের খুলশী ও পাঁচলাইশ থানায় অপহরণ, মারামারি, হত্যাচেষ্টা ও অস্ত্র আইনে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

পুলিশ জানায়, হেলাল বাদশার লেখাপড়া চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। নিজেকে কখনো ছাত্রলীগ, কখনো যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপকমিটির সদস্য, নগর ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক আরশেদুল আলমের (বাচ্চু) অনুসারী হিসেবেও পরিচিত। গতকাল খুলশী থানা কার্যালয়ে তিনি প্রথম আলোর কাছে তা স্বীকারও করেন।

তবে আরশেদুল আলমের দাবি, হেলাল বাদশাকে তিনি চেনেন না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে প্রশ্রয় দিই না। যারা এসব অপরাধ করে, তাদের বিচার হোক।’

পুলিশের হিসাবে, চট্টগ্রাম নগরে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। নগরজুড়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ তালিকা অনুযায়ী, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।

চলতি বছরের শুরুতে নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, নগরে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে কিশোর গ্যাংয়ের ‘বড় ভাই’দের প্ররোচনায় অপরাধে জড়াচ্ছে। শুরুতে তারা বীরত্ব দেখানোর জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। পরে তা থেকে আর বের হতে পারে না।

মুক্তিপণ চেয়ে ধরা বাদশা

পুলিশ সূত্র জানায়, ৭ মে নগরের বাদুরতলা বড় গ্যারেজ এলাকায় আরিফুর রহমান ও নাইম উদ্দিন নামের দুই বন্ধুকে রামদা, লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাত করা হয়। এ মামলায় ১০ মে পাঁচলাইশ থানা-পুলিশ বাদশাকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার জড়িয়ে পড়েন অপরাধে।

নগরের ব্যস্ততম সিঅ্যান্ডবি এলাকায় সড়কের পাশে নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের মাঠে গত শুক্রবার বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যায় ১৫ বছরের এক কিশোর। তিন বন্ধু তাদের মুঠোফোনগুলো তার কাছে জমা রেখে মাঠে খেলতে যায়। কিশোর ফোনসেটগুলো নিয়ে মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ হেলাল বাদশার নেতৃত্বে ১৫-২০ জন এসে তাকে মারতে শুরু করে। মারতে মারতে পাশের বাটা গলির ভেতরে একটি খালি জায়গায় নিয়ে যায়। এরপর তার বড় ভাইয়ের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। অপহৃত কিশোরের কথা ভিডিও করেও পাঠানো হয় পরিবারের কাছে।

সন্ধ্যার পর তাকে বাটা গলির খালি জায়গা থেকে আকবর শাহ থানার ইস্পাহানি গেট পেট্রলপাম্পের পেছন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও মারধর করা হয়। ছেলেটির দুই হাত, পা, পিঠ ও মুখে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। গতকাল সে খুলশী থানা কার্যালয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানের আঘাতের চিহ্ন দেখায়।

ওই কিশোরের বড় ভাই রাকিব হোসেন জানান, এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়ার পর তিনি ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশকে জানান। পুলিশ তৎপর হয়ে রাতেই সাত সহযোগী ও অস্ত্রসহ বাদশাকে গ্রেপ্তার করে।

বাদশার সহযোগীরা হলেন আবদুর রহমান, রাকিব হোসেন, কাউসার, মেহেরাজ সামি, শেখ সাদি হাসান, সাগর হোসেন ও সাইফুল ইসলাম। এঁদের বয়স ২০ থেকে ২৬। পরে খুলশী বাটা গলির খালি জায়গা থেকে দুটি কার্তুজসহ একটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র (এলজি) উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় অপহরণ ও চাঁদাবাজি এবং অস্ত্র আইনে দুটি মামলা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় আদালতের মাধ্যমে এঁদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ নেয়ামত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বাদশা কিশোর আরফিকে যেখানে নিয়ে আটকে রেখেছিলেন, সেটি এই দলের টর্চার সেল। ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই করে আসছে বাদশার নেতৃত্বে কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল। এই দলের অন্য সহযোগীদের ধরতে অভিযান চলছে।

ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই

নগরের ব্যস্ততম জিইসি এলাকার সানমার ওশান সিটির পার্শ্ববর্তী ফ্লাইওভার-সংলগ্ন ফুটপাতে থাকা অস্থায়ী টংদোকান থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা নেন বাদশা। আবার দলবল নিয়ে বিভিন্ন দোকানে খেয়ে টাকাও পরিশোধ করেন না। ভয়ে কেউ টাকা চান না। গতকাল সরেজমিন ওই এলাকায় ১০ জন দোকানদারের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁরা জানান, দোকানপ্রতি মাসে পাঁচ থেকে আট শ টাকা করে দিতে হয়। টাকা দেওয়ার পরও দলবল নিয়ে রেস্তোরাঁয় এসে খেয়ে যায়। ৬০ থেকে ৭০টি অস্থায়ী দোকান রয়েছে ওই এলাকায়। আশপাশে রয়েছে আবাসিক হোটেল, মার্কেটসহ শতাধিক দোকান। গত বছরের ১২ জুলাই দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে বাদশার সঙ্গে মানিক শেখ নামের ছাত্রলীগ নামধারী এক যুবকের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। ওই সময় বাদশার এক অনুসারীকে কুপিয়ে আহত করা হয়।

জিইসি এলাকার একটি নামকরা আবাসিক হোটেলে ৭ মে দলবল নিয়ে ভয়ভীতি দেখান বাদশা। বাদশা বিনা ভাড়ায় কক্ষে উঠতে চান। পরে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়। হোটেল কর্তৃপক্ষ পাঁচলাইশ থানায় বাদশার নামে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। এই থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁরা তদন্ত করছেন। বাদশা এলাকায় ত্রাস হিসেবে পরিচিত।

গতকাল পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় কথা হয় হেলাল বাদশা চৌধুরীর সঙ্গে। বলেন, ‘আমি কিশোর গ্যাং নেতা না। ব্যবসা করি।’ কী ব্যবসা, জানতে চাইলে চুপ থাকেন।

বাদশার হাতে অপহৃত হয়ে মুক্তি পাওয়া কিশোর প্রথম আলোকে বলেছে, তারা যেভাবে নির্যাতন করেছে, জীবিত ফিরে আসবে—এমন আশাই সে ছেড়ে দিয়েছিল।