অপরাধ
প্রতারণার টাকায় বাড়ি
নাইজেরিয়ার প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বাড়ি জব্দ। তাঁর বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে।
বিপ্লব লস্কর নামের এক ব্যক্তির কোটি টাকা দামের ডুপ্লেক্স বাড়ি, দামি গাড়িসহ কয়েক কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা বলছে, এই ব্যক্তি একসময় কুলি ছিলেন। ঢাকায় প্রতারণার মাধ্যমে এই সম্পদ গড়েছেন তিনি।
বছর দশেক আগে বিপ্লব নাইরেজিয়ার একটি প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সিআইডি জানিয়েছে, চক্রটি বিদেশ থেকে পার্সেলের মাধ্যমে উপহার পাঠানোর নাম করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করত। বিপ্লব প্রতারক চক্রের সদস্য হিসেবে নিজেকে শুল্ক কর্মকর্তা (কাস্টমস অফিসার) পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে বিপ্লবকে গ্রেপ্তার করে। মানুষের সঙ্গে প্রতারণা, জালিয়াতি ও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি তদন্ত শুরু করে সিআইডি অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। তদন্ত শেষে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) প্রতিরোধ আইনে বিপ্লবের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। গত সোমবার সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লবের জমিসহ বাড়ি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক মো. মনিরুজ্জামান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণার টাকায় বিপ্লব বাড়ি করেছেন। যেকোনো সময় তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাড়িটি বিক্রি করে দিতে পারেন। তাই বাড়িটি আদালতের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিপ্লবের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইনে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। দুটি মামলায় তিনি এখন কারাগারে।
বিপ্লবের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গেরাখোলায়। সিআইডি ও স্থানীয় সূত্র জানায়, বিপ্লবের বাবা কুলিগিরি করে সংসার চালাতেন। এখন তিনি স্থানীয় একটি বাজারে আখের রস বিক্রি করেন। তাঁর ছয় সন্তান। পরিবারে অভাবের কারণে বিপ্লবের স্কুলে যাওয়া হয়নি।
বিপ্লবের গ্রামের বাসিন্দা মাসুদ শেখ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিপ্লব অনেক বছর আগে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় যান। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর জানতে পারলাম তিনি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। তবে তাঁর বাবা ও ভাইয়েরা খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন।’
বিপ্লব জমি কিনে বাড়ি করেছেন ঢাকার পূর্বাচলের কাছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ইছাপুরা টেকনোয়াদ্ধায়। সেখানে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি এক বছর আগে জমি কিনেছিলেন এক চিকিৎসকের কাছ থেকে। দাম পড়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সেখানে বাড়িটি করতে তাঁর প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই বাড়িতেই বিপ্লব স্ত্রীসহ থাকতেন। চার মাস আগে সেখান থেকে ডিবি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। বিপ্লব গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে বাড়িটি ছেড়ে যান তাঁর স্ত্রী।
রূপগঞ্জে বিপ্লবের বাড়িতে গিয়ে গতকাল শুক্রবার দেখা যায়, ফটক বন্ধ। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর এক ব্যক্তি এসে ফটক খুলে দেন। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটির মূল দরজায় তালা ঝুলছে। বন্ধ দরজায় ঝুলছে আদালতের জারি করা জব্দ করার নির্দেশনা। বাড়ির উত্তর পাশে একটি আধপাকা টিনের ঘর। সেখানে থাকেন ফরিদ মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিপ্লবের জমির বাইরে একজন চিকিৎসকের জমি সেখানে রয়েছে। সেই জমি তিনি দেখাশোনা করেন।
ফরিদ আরও বলেন, বিপ্লব নিজেকে কাপড়ের ব্যবসায়ী পরিচয় দিতেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, বিপ্লব যে চক্রের সদস্য ছিলেন, সেই চক্রটি চালাত বাংলাদেশে বসবাসকারী নাইজেরীয় কয়েক জন প্রতারক। তাঁরা বাংলাদেশি ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও চাকরিজীবীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগ করতেন। একসময় বন্ধুত্বের কথা বলে ডলার বা দামি উপহার পাঠানোর প্রস্তাব দিতেন। উপহার পাঠানোর কথা বলার কিছুদিন পর বিপ্লব নিজেকে শুল্ক কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে উপহারের গ্রহীতাকে ফোন করতেন।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, বিপ্লব ভুক্তভোগীকে ফোন করে বলতেন, উপহার কাস্টমস থেকে ছাড়াতে টাকা লাগবে। কখনো বলতেন উপহারের বাক্সে ডলার রয়েছে। বিষয়টি পুলিশ ও সাংবাদিকেরা জেনে গেছেন। মীমাংসা না করলে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে। মীমাংসার জন্য রাজি হলে বড় অঙ্কের টাকা দাবি করতেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন এ চক্রের সদস্যরা।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, গোপালগঞ্জ]