আরও ৫ জন প্রশ্নপত্র ফাঁসে অভিযুক্ত, আছেন পিএসসির কর্মকর্তা, অফিস সহায়ক, গাড়িচালকও
পাঁচজন হলেন পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান।
রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ছয় কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে। কেবল এই ছয়জনই নন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে পিএসসির আরও পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম সামনে এসেছে; যাঁরা বিভিন্ন সময় ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। আবার অফিস সহায়ক ও গাড়িচালকও আছেন।
এই পাঁচজন হলেন পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান।
পিএসসি সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে এই পাঁচজনকেই একসময় চাকরিচ্যুত করেছিল পিএসসি। পরে এনামুল বশির ও আবদুর রউফ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পান। অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান চাকরিচ্যুত হয়েছেন দুই বছর আগে। সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায় গত বছর অবসরে গেছেন।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। পরে আইনি প্রক্রিয়ায় তাঁরা চাকরি ফিরে পান। অবসরে গিয়েও অপকর্মে জড়িত কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিএসসির পরিচালক এনামুল বশিরের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে তাঁকে ২০১১ সালে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই বছরই তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে যান। ২০২১ সালে তিনি চাকরি ফিরে পান। গত বছরের মার্চে তিনি অবসরে যান। অবশ্য এনামুল বশির গতকাল বুধবার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল।
আবদুর রউফের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে ২০১০ সালে। তখন তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাঁকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। ওই ঘটনায় পিএসসি তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্যতা পাওয়ায় ২০১৩ সালে আবদুর রউফকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে যান। আইনি প্রক্রিয়া শেষে গত বছর চাকরি ফিরে পান। এরপর আবদুর রউফ প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হন।
আবদুর রউফ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে ২০১০ সালে পুলিশ সন্দেহবশত গ্রেপ্তার করেছিল; কিন্তু কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় পরে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসি কেন ফৌজদারি মামলা করেনি, সে প্রশ্ন থেকে যায়।মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া, সরকারি চাকরির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
তবে রেলের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ৫ জুলাই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার উপপরিচালক মো. আবু জাফর পিএসসির যে শাখা দেখতেন, সেই শাখায় সহকারী পরিচালক পদে রয়েছেন আবদুর রউফ। দুজন পাশাপাশি রুমে বসেন। এই শাখা (ইউনিট ১২) থেকে রেলওয়ে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন নন–ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়।
ডন কুমার ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি পিএসসিতে অফিস সহায়ক পদে যোগ দিয়েই প্রশ্নপত্র ফাঁসেও জড়িয়ে পড়েন। পিএসসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চাকরি দেওয়ার কথা বলে পটুয়াখালী সদর উপজেলার ইমরুল ইসলামের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নেন ডন কুমার; যার কারণে ২০২২ সালেই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন। তাঁর মামলা এখনো চলমান।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযুক্ত হয়ে পুনরায় চাকরিতে ফিরে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির যুগ্ম সচিব আবদুল আলীম খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কাউকে চাকরিচ্যুত করলে তিনি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে যান। পরে আদালতের দ্বারস্থ হন। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আদালতের আদেশ শোনা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক।’ তিনি বলেন, পিএসসি তদন্তকারী সংস্থা নয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে দুদকে চিঠি দেওয়া হয়। এর বাইরে আর কিছু করার থাকে না।
এই পাঁচজন হলেন পিএসসির পরিচালক এনামুল বশির, সহকারী পরিচালক আবদুর রউফ, সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, অফিস সহায়ক ডন কুমার ও গাড়িচালক আতাউর রহমান।
সর্বশেষ রেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) গতকাল চিঠি দিয়েছে পিএসসি।
পিএসসির গাড়িচালক আতাউর রহমানের বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। পিএসসির দাপ্তরিক তথ্য বলছে, তিনি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার সলিল বরণ দাসের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা নেন। এই ঘটনায় ২০২২ সালে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধেও প্রশ্নপত্র পত্র ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে। তিনি গত বছর অবসরে যান। তবে গত শুক্রবার রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে তাঁর নাম আসে। তিনি এখন পলাতক।
পিএসসির ভেতরেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র কাজ করছে। এর মধ্যে কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ এখনো আড়ালে রয়ে গেছেন।সরকারি চাকরির বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া
রেলের এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ৫ জুলাই ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ছয়জনই পিএসসির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাঁরা হলেন উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম; সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, কর্মচারী (ডেসপাচ রাইডার) মো. খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম এবং সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী। এই ব্যক্তিরা প্রায় দেড় যুগ ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলে সিআইডি সূত্রে জানা গেছে। এঁদের কয়েকজন দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
সরকারি চাকরির বিধিবিধান বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, পিএসসির ভেতরেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের একটি চক্র কাজ করছে। এর মধ্যে কেউ ধরা পড়েছেন, কেউ এখনো আড়ালে রয়ে গেছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক সংস্থা পিএসসি কেন ফৌজদারি মামলা করেনি, সে প্রশ্ন থেকে যায়।