বইমেলায় খাবারের দোকানে দিনে ২০ হাজার টাকা চাঁদা তুলছেন এসআই

বইমেলার প্রবেশমুখে বসানো অবৈধ দোকান
ছবি: প্রথম আলো

একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের কয়েকটি খাবারের দোকান থেকে কিছু পুলিশ সদস্য নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছেন ও বিনা মূল্যে খাবার খাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় বইমেলার টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশমুখে বসে ভাসমান দোকানের আরেক মেলা। অবৈধ এসব দোকান বসানোর সুযোগ দিয়ে সেখান থেকেও কিছু পুলিশ সদস্য এককালীন টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, এমন অভিযোগ উঠেছে।

খাবারের দোকানিরা এসব কর্মকাণ্ডের জন্য বইমেলার ইনচার্জের দায়িত্বে থাকা রাজধানীর শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জুন্নুন হোসাইনকে দায়ী করছেন। তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

খাবারের দোকানে চাঁদাবাজি

বইমেলায় এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব অংশে খাবারের দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে প্রায় কোটি টাকায়। এই কয়টি দোকান থেকে দৈনিক অন্তত ২০ হাজার টাকা চাঁদা নিচ্ছে পুলিশ।

এক দোকানি নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত দোকানগুলো চলে। অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে এবার খাবারের দোকানে ক্রেতা কম। অনেক টাকা খরচ করে খাবারের দোকান নিয়েছি। এর মধ্যেই আমিসহ সব দোকানি পুলিশের এসআই জুন্নুন হোসাইনকে দৈনিক চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছি। সব মিলিয়ে এবার ১০-১৫ লাখ টাকা লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছি।’

আরেক দোকানি বলেন, ‘পুলিশের সদস্যরা বিনা মূল্যে আমাদের দোকানে খাবার খাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে এসে বিনা মূল্যে এক ডজন-দুই ডজন পানির বোতলও নিয়ে যাচ্ছেন।’

বইমেলায় ভাসমান দোকানের কয়েকটি
ছবি: প্রথম আলো

ভাসমান দোকান বসিয়েও চাঁদাবাজি

১ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলার শুরুর দিন থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসিসংলগ্ন অংশের প্রবেশমুখে অন্তত তিন ডজন ভাসমান দোকান বসে। সেখানে চটপটি-ফুচকাসহ ভাজাপোড়া খাবার, চুড়িসহ হরেক পণ্যের পসরা সাজানো হয়। ছিল নাগরদোলাও। শাহবাগ থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা চাঁদা দিয়ে দোকানগুলো বসে।

ভাসমান দোকানি ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দোকানভেদে পুলিশকে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে বইমেলার প্রবেশমুখে দোকানগুলো বসানো হয়। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে এলে এসব দোকান তুলে দিতে বলা হয়। তখন পুলিশের কিছু সদস্য মেলার প্রবেশমুখের পাশে স্থাপিত টিনের বেড়া থেকে কয়েকটি টিন সরিয়ে মানুষের যাতায়াতের রাস্তা করে দেন। ভাসমান দোকানগুলো তখন টিনের অন্য পাশে বসে। ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি দোকানগুলো সেখানেই ছিল।

মাঝখানে একদিন বন্ধ থাকার পর আজ বুধবার বিকেল থেকে ভাসমান দোকানগুলো আবার বসেছে। তবে এবার বইমেলায় প্রবেশের মূল ফটক থেকে কিছুটা পেছনে ও উদ্যানের ফটকে বসানো হয়েছে দোকানগুলো। দোকানগুলোয় উচ্চ মূল্যে নিম্নমানের খাবার বিক্রি হচ্ছে।

টিন সরানোর জন্যও টাকা

বইমেলার প্রতিটি খাবারের দোকানে একটি করে প্রবেশমুখ রাখা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা টাকার বিনিময়ে একটি দোকানের পেছনের টিন খুলে নতুন একটি প্রবেশপথ তৈরি করে দেয় বলে অভিযোগ দোকানিদের একাংশের। এ ঘটনায় দোকানিদের ওই অংশ ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, যে দোকানের পেছনের অংশে টিন খুলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে দুটি পথ দিয়ে ক্রেতারা প্রবেশ করছেন। এতে সেখানে বিক্রিও বেশি হচ্ছে। কিন্তু অন্য দোকানে একটি প্রবেশমুখ থাকায় ক্রেতা কম থাকছে।

এ বিষয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান বরাবর চিঠি দেন বিসমিল্লাহ কাবাব অ্যান্ড বিরিয়ানি নামের একটি দোকানের পরিচালক সেলিম মিয়া। চিঠিতে বলা হয়, ‘যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বইমেলায় ফুডকোর্টের স্টল পাই। তখন আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে ফুডকোর্টে একটির বেশি ফটক থাকবে না। কিন্তু মেলার কয়েক দিন না যেতেই টিনের বেড়া খুলে ফুড কোর্ট-১-এ একাধিক ফটক বানানো হয়েছে। এ ছাড়া মেলার টিএসসিসংলগ্ন প্রবেশমুখে অসংখ্য ভ্রাম্যমাণ দোকান গড়ে উঠেছে। বারবার জানানোর পরও আপনারা এ বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আমাদের ফুডকোর্টটি মাঠের শেষ প্রান্তে হওয়ায় আমরা ভীষণভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। ইতিমধ্যে মেলার ১২ দিন চলে গেছে। এমন অবস্থায় আমাদের ফুডকোর্টের অর্ধেক ইউনিটের টাকা ফেরত দেওয়া হোক অথবা ফাঁকা জায়গায় স্টল স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হোক। অন্যথায় আমাদের সবাইকে পথে বসতে হবে।’

চিঠি পাওয়ার পর বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে টিনের বেড়া আটকে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরের দিন থেকে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের টিএসসিসংলগ্ন ফটকে বসা ভাসমান দোকানও অপসারণ করা হয়। একই সঙ্গে খুলে দেওয়া টিনের বেড়া পুনরায় স্থাপন করা হয়। যদিও এক দিনের মাথায় টাকার বিনিময়ে আবার সেই টিনের বেড়া খুলে দেওয়া হয়। এর পেছনেও এসআই জুন্নুনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছে দোকানিদের একাংশ।

এসব বিষয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও এবারের বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কে, কোথায়, কোন প্রভাব দেখিয়ে কী করছেন, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, খাবারের দোকানগুলো চারপাশ থেকে ঘেরাও করা ছিল। হঠাৎ করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নিয়ম না মেনে দোকানের পেছনের টিন খুলে ফেলা হচ্ছে, কেউ মেলার প্রবেশমুখে দোকান বসিয়ে দিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার রাতে সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে সবকিছু ঠিক করে দিয়ে আসি। গতকাল মঙ্গলবার থেকে আবার অনিয়ম শুরু হয়। আজ বুধবার আবারও ঠিক করা হয়।’

একুশে বইমেলার স্টলে পছন্দের বই দেখছেন পাঠকেরা। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
ফাইল ছবি

এদিকে বইমেলায় চাঁদাবাজির অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ ও এসআই জুন্নুন হোসাইন। ওসি বলেন, বইমেলা থেকে চাঁদা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আর এসআই জুন্নুনের দাবি, ‘চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন। সুযোগ না পেলে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা চালান। আইনগতভাবে আমাদের যা করণীয়, তা করছি। বাংলা একাডেমির সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি।’

শাহবাগ থানার খরচপাতির জন্য দোকান

বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বাংলা একাডেমির কাছ থেকে বিনা মূল্যে দুটি দোকান বরাদ্দ পেয়েছে শাহবাগ থানা–পুলিশ। দোকান দুটি পুলিশ ১৩ লাখ টাকায় এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। কিনে নিয়ে নূর কাবাব অ্যান্ড ফাস্টফুড ও ক্যাফে ফোর স্টার নামে দোকান দুটি চালাচ্ছেন বিল্লাল নামের এক ব্যক্তি।

দোকান বিক্রির টাকা শাহবাগ থানার কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন থানারই একাধিক পুলিশ সদস্য। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অর্থকড়ির সঙ্গে আমরা জড়িত নই।’ দোকান দুটি কারা চালাচ্ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওখানে যা যা আছে, সবই বাংলা একাডেমির নিয়ন্ত্রণে। আমরা কারও কাছে দোকান বিক্রি করিনি।’

শাহবাগ থানা-পুলিশকে বইমেলায় দোকান বরাদ্দ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান মেলায় থানার কন্ট্রোল রুমের (নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) খরচপাতি পোষানোর দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, ‘শাহবাগ থানার জন্য দুটি দোকান বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যান্য বছর একটা দোকান নিলেও এবার তারা দুটি নিয়েছে। তবে এর জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘বইমেলায় তাদের একটা কন্ট্রোল রুম আছে। সেখানে নাকি খরচপাতি হয়। দোকান বিক্রির বিষয়টি আমরা জানি না। দোকান যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরাও তা স্বীকার করেননি।’