এক উপজেলায় ১৪ বছরে ৯০ খুন, হত্যা মামলায়ও সমঝোতা হয়

২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার বগুড়া ইউনিয়নের রত্নাট গ্রামে আওয়ামী লীগের দুই নেতার রাজনৈতিক বিরোধ থেকে প্রতিপক্ষের হামলায় খুন হন দুই ব্যক্তি—আলম শেখ (৫৪) ও মোনছের আলী (৫২)। এক দশক হতে চলল, সেই দুই খুনের মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

ঝিনাইদহ শহর থেকে শৈলকুপার বগুড়া বাজারের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটারের মতো। ৯ জুন বিকেলে বাজারটিতে গিয়ে পাওয়া গেল খুন হওয়া আলম শেখের ছেলে শিমুল শেখকে। বাবা যখন খুন হন, তখন তাঁর বয়স ছিল ২০ বছর। এখন ৩০। তিনি কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালান।

‘এলাকার মধ্যে যার দল বড়, নেতাদের কাছে (ক্ষমতাসীন দলের নেতা) তাঁর গুরুত্ব বেশি। এ জন্যই সামাজিক দল বানিয়েছিলাম।’
—মালেক বিশ্বাস, কথিত সমাজপতি, শৈলকুপা

পিতার খুনের বিচার হয়েছে কি না, জানতে চাইতেই শিমুল শেখ প্রথম আলোকে বললেন, বিচার হয়নি। ‘সমাজপতি’দের সালিসে ২০২০ সালে সমঝোতা হয়েছে। তাঁরা পেয়েছেন ছয় লাখ টাকা। বিচার যে হবে না, সেটা তাঁরা জানেন। মেনেও নিয়েছেন। মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

বগুড়া বাজারে যখন মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন ৪০ জনের মতো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের ইউনিয়নে খুনোখুনি ও পরবর্তী সময়ে সমঝোতার কথা জানাচ্ছিলেন। ভিড়ের মধ্যে ছিলেন ২০১৪ সালে খুনের শিকার মোনছের আলীর ছেলে তুহিন হোসেনও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছি। সমঝোতা যেহেতু করতেই হয়েছে, এ জন্য টাকা নিয়েছি।’

শৈলকুপা উপজেলায় এমন খুনোখুনি নিয়মিত ঘটনা। নেপথ্যে রাজনৈতিক বিরোধ। সেই বিরোধ থেকে তৈরি হয় কথিত সামাজিক দল, যা অনেকটা বাহিনীর মতো কাজ করে। দলের নেতৃত্ব দেন সমাজপতিরা। তাঁদের প্রশয় দেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। ফলে খুনোখুনি বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে শৈলকুপায় ১২৭ জন ব্যক্তি খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৯০ জন খুন হয়েছেন কথিত সমাজপতিদের দ্বন্দ্বের জেরে। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের বছরগুলোতে খুনোখুনি বেশি হয়েছে।

গ্রামগুলোতে মারামারি, হামলা, পাল্টা-হামলা ও খুনোখুনি দৈনন্দিন ঘটনা হলেও বিরল খুনের ঘটনায় শাস্তি। ৯০টির মধ্যে একটি খুনের বিচার হয়েছে, এমন নজির কেউ তুলে ধরতে পারলেন না। বেশির ভাগ ঘটনায় গ্রাম্য সালিসে সমঝোতা হয়েছে। বিপুল টাকা আসামিদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সেই টাকার একাংশ স্বজনহারা পরিবারকে দিয়ে বাকিটা ভাগ-বাঁটোয়ারা করেছেন সমাজপতি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।

‘আমার ইউনিয়নে নির্বাচনের (২০২২ সালের ইউপি ভোট) আগে ও পরে আটজন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আমার পক্ষেরই ছয়জন।’
—মাহমুদুল হাসান, চেয়ারম্যান ও আ. লীগের সাধারণ সম্পাদক, শৈলকুপার সারুটিয়া ইউনিয়ন

ওদিকে আদালতে মামলা চলছে। স্বজনহারা পরিবারগুলোর সদস্যরাই আদালতে গিয়ে সমাজপতিদের শিখিয়ে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ফলে মামলায় শাস্তির সুযোগ থাকছে না।

খুনের শিকার এক ব্যক্তির এক স্বজন নাম প্রকাশ নাম করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে বিচার চলছে ঠিকই, কিন্তু মামলায় কারও সাজা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরাই আদালতে দোষীদের পক্ষে কথা বলেন। এটা সমাজপতিদের করে দেওয়া সমঝোতার অংশ। তিনি বলেন, সালিসে সমঝোতার পর আদালতে গিয়ে কেউ যদি সত্য কথা বলেন, তাঁকে গ্রামছাড়া হতে হবে। প্রাণ হারানোর আশঙ্কাও থাকে।

গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব

শৈলকুপা ঝিনাইদহের ছয়টি উপজেলার একটি। স্থানীয় বাসিন্দা, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা বলছেন, উপজেলাটির প্রায় সব গ্রামে কথিত সামাজিক দল ও তাদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। জাতীয় তথ্য বাতায়নের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, উপজেলাটিতে গ্রামের সংখ্যা ২৮৯। এই উপজেলার প্রতিবেশী ঝিনাইদহ সদর উপজেলা, হরিণাকুণ্ডু, কুষ্টিয়ার কুমারখালী ও খোকসা এবং রাজবাড়ীর পাংশায় এত খুনোখুনি নেই।

শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামে ৭ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত চার দিন ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের পর থেকে বিভিন্ন এলাকায় ‘সামাজিক দল’ গঠন করে কথিত সমাজপতিদের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বাড়তে থাকে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলেও শৈলকুপার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাই। তিনি টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য। স্থানীয় রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে তিনি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নিজের সমর্থকদের নিয়ে দল গঠন করেন। এই দলগুলোই ‘সামাজিক দল’ নামে পরিচিতি পায়। দলের প্রধানকে বলা হয় ‘সমাজপতি’।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবদুল হাইয়ের সমর্থিত সামাজিক দলগুলো আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে আবদুল হাইয়ের বিরোধী পক্ষও বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক দল গঠন শুরু করে। পাল্টাপাল্টি এই সামাজিক দল গঠন এখনো চলছে।

আবদুল হাই গত মার্চে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নায়েব আলী জোয়ারদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হানাহানি, লুটপাটের রাজনীতি চলছে প্রায় ২০ বছর ধরে। এতে পুরো শৈলকুপায় অস্থিরতা হয়েছে, খুনোখুনি হয়েছে। তিনি শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন।

যদিও শান্তির লক্ষণ নেই। গত ২২ মে শৈলকুপার ধলোহরাচন্দ্র ইউনিয়নে দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন। ভাঙচুর করা হয় ৪০টির বেশি বাড়িঘর। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই সমাজপতির সমর্থকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়েছিল। আসামি ছিনতাইয়ের জন্য ৯ জুন শৈলকুপা থানায় হামলা ও ভাঙচুরের পেছনেও স্থানীয় সমাজপতিরা রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র।

সংঘর্ষের ঘটনায় ব্যবহার করা হয় দেশি ধারালো অস্ত্র, হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এসব অস্ত্র থাকে। কখনো কখনো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও দেখা যায়। শুধু প্রতিপক্ষকে মারধর ও খুন নয়, বাড়িতে বাড়িতে লুটপাটও চালানো হয়।

চার কারণ

শৈলকুপায় ৩০টি খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কারণ মোটামুটি একই—১. রাজনৈতিক বিরোধ ও উসকানি। ২. স্থানীয় পর্যায়ে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার। ৩. সামাজিক দলের সদস্যের রাজনৈতিক পক্ষ পরিবর্তন। ৪. খুনের বিচার না হওয়া।

খুনের শিকার ব্যক্তি এবং খুনে জড়িতরা কোনো না কোনো সামাজিক দলের সদস্য ছিলেন। এই সামাজিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলের নেতাদের হাতে।শৈলকুপার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা পর্যায়ে অন্তত ৩৫ জন নেতা রয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন সমাজপতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এঁরা আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের পাঁচজন নেতা—তাঁরা হলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদার, শৈলকুপা উপজেলা নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা আরিফ রেজা, শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক শামীম হোসেন মোল্লা, শৈলকুপা পৌরসভার মেয়র কাজী আশরাফুল আজম ও ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান। এঁদের তিনজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা দলাদলি ও খুনোখুনি আছে বলে স্বীকার করেছেন। তবে নিজেদের দায় অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এও বলেছেন, তাঁদের ওপরই হামলা বেশি হয়।  

প্রথম আলোর বিশ্লেষণে আসা ৩০টি খুনের ঘটনার ২৪টিতে সরাসরি রাজনৈতিক নেতাদের ইন্ধন ছিল বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ। এমন একটি ঘটনা হলো সারুটিয়া ইউনিয়নের ভাটবাড়িয়া গ্রামের জসীম উদ্দিন খুন। তিনি পেশায় একজন পোশাক কারখানার কর্মী। স্ত্রী, বোন ও মাকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার সাভারে। গ্রামে ফিরে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তিনি সামাজিক দলের বিরোধের জেরে খুন হন।

৮ জুন জসীমের বাড়িতে গিয়ে তাঁর পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মামাতো ভাই আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জসীমের পরিবারের কেউ গ্রামে থাকেন না। ইউনিয়ন পরিষদের ভোটকে কেন্দ্র করে তাঁকে খুন করা হয়। তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর জসীমের চারজন চাচাতো ভাই ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন।

২০২২ সালের সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধ ছিল বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি জুলফিকার কায়সারের মধ্যে। সারুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে ৮ জুন পাওয়া যায় মাহমুদুল হাসানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে নির্বাচনের আগে ও পরে আটজন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে আমার পক্ষেরই ছয়জন। খুনের জন্য তিনি জুলফিকার কায়সারকে দায়ী করেন।

অন্যদিকে সারুটিয়ায় খুনোখুনির পেছনে মাহমুদুল হাসানকে দায়ী করেন জুলফিকার কায়সার। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে জেতার জন্য মাহমুদুল হাসানের লোকজন নিজেরাই খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন।

রাজনৈতিক ইন্ধন ও সমাজপতিদের দ্বন্দ্বের জেরে ২০২৩ সালের অক্টোবরে উপজেলার আবাইপুর ইউনিয়নের মীন গ্রামে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান ওরফে রিপনকে। হাবিবুর ছিলেন একজন সমাজপতি। তাঁকে খুনের মামলার আসামি রঞ্জু মিয়া তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী।

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও হাইওয়ে পুলিশের প্রধান শাহাবুদ্দিন খানের বাড়ি শৈলকুপা উপজেলায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে গ্রামের স্বার্থে সমাজপতিরা কাজ করতেন। তখন সালিস হতো গ্রামে শান্তি ও শৃঙ্খলার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য। তাঁরা সমাজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বিরোধ তৈরি নয়, নিষ্পত্তি করতেন। এখন পরিস্থিতি হয়েছে উল্টো। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সমাজের সচেতন ও শিক্ষিত মানুষদের সংযুক্ত করে প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে।

সালিসে ‘সমঝোতা’

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যে ৩০টি খুনের মামলার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়, এর মধ্যে ১৬টি হত্যার ঘটনা ঘটে ৫ থেকে ১০ বছর আগে। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে ১২টি ঘটনাতেই বাদী-বিবাদী সমঝোতা করেছেন। ৮টি ঘটনার বাদী সমঝোতার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকারও করেছেন। সবাই বলেছেন, রাজনৈতিক চাপে তাঁরা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনাতেই টাকার লেনদেন হয়েছে।

বগুড়া ইউনিয়নের রত্নাট গ্রামে আলম শেখ ও মোনছের আলী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সালিস ডেকে সমঝোতা করাতে ভূমিকা রেখেছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম। তিনি এখন অসুস্থ। তাঁর ছেলে ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রাজীব বাহাদুর প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে সালিসের মাধ্যমে খুনের ঘটনা সমঝোতা হয়। এখানে টাকার লেনদেন করেছে বাদী ও বিবাদীপক্ষ।

দুই খুনের ঘটনায় দুই স্বজন হারানো পরিবার পেয়েছিল ৬ লাখ করে ১২ লাখ টাকা। তবে স্থানীয় সূত্রের দাবি, দুটি হত্যা মামলার দুই শতাধিক আসামির কাছ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছিল। আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কারও কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা, কারও কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। টাকা আদায়ের নেতৃত্বে ছিলেন দুই সমাজপতি মালেক বিশ্বাস ও মজিদ বিশ্বাস। তাঁরা দুজন আবার হত্যা মামলা দুটির প্রধান আসামি।

মালেক বিশ্বাস মুঠোফোনে প্রথম আলোর কাছে টাকা সংগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, তিনি নিজে দিয়েছেন তিন লাখ টাকা। অন্য আসামিদের কাছ থেকে খুব কম পরিমাণে টাকা নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার মধ্যে যার দল বড়, নেতাদের কাছে (ক্ষমতাসীন দলের নেতা) তাঁর গুরুত্ব বেশি। এ জন্যই সামাজিক দল বানিয়েছিলাম। রাজনৈতিক বিরোধে জড়ানোর কারণে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছিল।’

দণ্ডবিধি অনুযায়ী খুনের মামলায় সমঝোতার সুযোগ নেই। বাদী শুধু মামলা করেন, রাষ্ট্রপক্ষ তা চালায়। তারপরও কীভাবে সমঝোতা হয়, তা জানতে চেয়েছিলাম আইনজীবী শামসুজ্জামানের কাছে, যিনি ঝিনাইদহ জেলা দায়রা জজ আদালতে ১০ বছর ধরে আইন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁর বাড়ি শৈলকুপা উপজেলায় এবং তিনি মূলত আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন।

শামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, শৈলকুপায় খুনের মামলার ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বাদী-বিবাদী সমঝোতায় চলে যান। সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসেন না, সাক্ষ্য দিলেও প্রকৃত ঘটনার বর্ণনা দেন না। ফলে মামলা ঝুলে থাকে, বিচার নিষ্পন্ন করা যায় না।

একই সমস্যার কথা বলেন ঝিনাইদহ দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইসমাইল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বজনহারা পরিবারগুলোই বিচার চায় না। সমঝোতায় চলে যায়। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ যতই চেষ্টা করুক না কেন, জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব নয়।

স্বজনহারা পরিবারগুলো বিচার কেন চায় না, কেন সমঝোতা করে, সেই প্রশ্নের উত্তর একটাই—সমঝোতা না করলে বাড়ি ছাড়তে হবে, হয়রানি হতে হবে। প্রাণ হারানোর আশঙ্কাও থাকে।

২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি শৈলকুপার বগুড়া ইউনিয়নের বগুড়া গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কল্লোল হোসেন নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় বগুড়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম শিমুলসহ ৮২ জনকে আসামি করা হয়েছিল। ঘটনার পর কল্লোলের পরিবার আট মাস বাড়ি ছাড়া ছিল। পরিবারের অন্য সদস্যরা ফিরলেও এখনো বাড়িতে ফিরতে পারেননি তাঁর ভাই মিল্টন খন্দকার।

মিল্টন প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় সমঝোতা করতে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। রাজি না হওয়ায় আরেকটি হত্যা মামলায় তাঁকে আসামি করা। ওই মামলায় তিনি এক বছরের বেশি সময় কারাগারে ছিলেন। যদিও তদন্তের পর তাঁকে ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

বগুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামের কাছে মুঠোফোনে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কল্লোল হত্যার ঘটনার সময় তিনি এলাকায় ছিলেন না। তাঁর নামে অভিযোগ মিথ্যা এবং তিনি কাউকে সমঝোতার প্রস্তাবও দেননি।

মিল্টন কীভাবে আরেক হত্যা মামলায় আসামি হলেন, তা জানেন না বলে দাবি করেন শফিকুল। যদিও মিল্টন বলছেন, হয়রানির উদ্দেশ্যে শফিকুলের ইশারায় হত্যা মামলাটিতে তাঁকে আসামি করা হয়েছিল।

সামাজিক দলে যোগ না দিলে...

শৈলকুপার গ্রামগুলোতে বড় সামাজিক দল আছে, ছোট সামাজিক দল আছে। দেখা যায়, আশপাশের কয়েকটি বাড়ির ১৫-২০টি পরিবার নিয়ে একটি দল ঘোষণা করা হলো। নিরীহ কারও পক্ষে দলে যোগ না দিয়ে থাকার উপায় নেই। যোগ না দিলে, হামলা, সহিংসতায় অংশ না নিলে বিপদে পড়তে হয়। কোথাও সহায়তা পায় না নিরীহ পরিবারগুলো।

ঝিনাইদহ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও শৈলকুপা পৌরসভার মেয়র কাজী আশরাফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন এ ধরনের ঘটনাগুলো নিরসনে কখনোই আন্তরিক ছিল না। কখনো কখনো প্রয়াত সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের পক্ষ নিয়ে তা উসকে দেওয়া হয়েছে।

মেয়রের অভিযোগ ও স্থানীয় লোকজনের বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল ঝিনাইদহ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আজিম-উল-আহসানের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর আগে শৈলকুপায় যে পরিস্থিতি ছিল, এখন ধীরে ধীরে সেটির উন্নতি হচ্ছে। স্থানীয় বিরোধের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সে জন্য পুলিশ কাজ করছে। কোনো ঘটনা ঘটে গেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

অবশ্য স্থানীয় লোকজন বলছেন, গ্রামগুলোতে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, কার্যকর সমাজপতিদের শাসন। হামলার ভয়ে, প্রাণ হারানোর ভয়ে অনেক তরুণ, অনেক যুবক গ্রামছাড়া। একটি গ্রামে গিয়ে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে। তাঁদের চার ছেলে ভয়ে গ্রামে যেতে পারেন না। বৃদ্ধা ৯ জুন প্রথম আলোকে বলেন, পবিত্র ঈদুল আজহা (১৭ জুন উদ্‌যাপিত) আসছে। ছেলেদের মুখ দেখা হবে না।

বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার কাছে তাঁদের ছেলেদের মুঠোফোন নম্বর চেয়েছিলাম। তাঁরা দিতে রাজি হননি। তাঁদের সন্দেহ আমরা হয়তো কোনো সামাজিক দলের লোক।

‘বিচার না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়’

বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদীর চরাঞ্চল, শৈলকুপাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় দশকের পর দশক ধরে খুনোখুনি হচ্ছে। এসব কি নিরসনযোগ্য?

সমাজবিজ্ঞানী ও আইনজীবীরা বলছেন, অবশ্যই নিরসনযোগ্য। সে জন্য রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কৌশল নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে। সহিংসতাপূর্ণ জেলা, উপজেলায় দেখা যায়, খুনের ঘটনায় বিচার হয় না। যদি রাজনীতিবিদেরা প্রশ্রয় না দিতেন, যদি পুলিশ তৎপর থাকত, খুনের ঘটনায় যদি শাস্তি হতো; তাহলে খুনোখুনি বন্ধ হয়ে যেত।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার কম। এটা ২০ শতাংশের আশপাশে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশের তদন্তের দুর্বলতা ও সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যান। যেকোনো অপরাধের বিচার না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। তিনি বলেন, রাজনীতিতে এখন বড় যোগ্যতা হয়ে দাঁড়িয়েছে পেশিশক্তি। সেই পেশিশক্তির জন্যই বাহিনী গঠনের প্রবণতা দেখা যায়।