কড়াইলে ২ কাউন্সিলরের শাসন

বস্তির ঘরে অবৈধ গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে টাকা তোলেন দুই কাউন্সিলরের অনুসারীরা।

কড়াইল বস্তির একটি কক্ষে স্বামীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন মমতাজ বেগম। তাঁদের বসবাসের ছোট কক্ষটিতে রয়েছে একটি খাট, একটি ফ্রিজ ও ভাত–তরকারি রাখার একটি স্টিলের মিটসেফ। এ কক্ষে থাকার জন্য তাঁকে মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। সেখানে বৈদ্যুতিক বাতিসহ অন্তত পাঁচটি খাতে তাঁকে দিতে হয় আরও প্রায় দুই হাজার টাকা। মমতাজ প্রথম আলোকে বলেন, একটি কক্ষের জন্য তিনি মাসে ভাড়া দেন পাঁচ হাজার টাকা। এ ভাড়া নেন স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তিনটি সরকারি সংস্থার ৯৩ একর জমি দখল করে গড়ে তোলা হয় কড়াইল বস্তি। সেখানে প্রায় ৪০ হাজার ঘর রয়েছে। বস্তি ঘিরে আরও রয়েছে ১০ হাজার ছোট–বড় দোকান। প্রায় পাঁচ হাজার ব্যক্তি এসব ঘর ও দোকানের মালিক। এসব ঘর ও দোকানের অধিকাংশই চলে অবৈধ পানি ও বিদ্যুৎ–গ্যাসের সংযোগে।

কড়াইল বস্তির প্রতিটি কক্ষে দুই থেকে চারজন বাস করেন। ৫ থেকে ১৫টি পরিবারের জন্য রয়েছে একটি শৌচাগার। সকাল-বিকেলে গোসলখানা ব্যবহারের জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায়। বস্তির রাস্তার ওপর ময়লা রাখা হয়। অনেক সময় দু–তিন দিনের ময়লা জমে তীব্র দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুন

দিনমজুর, পোশাক কারখানার শ্রমিক, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের দুই লাখের বেশি মানুষ কড়াইলে বাস করেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাড়া তোলা হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকা। বছরে এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৫০ কোটি টাকায়। এ টাকা তোলেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক স্থানীয় দুই কাউন্সিলর ও তাঁদের অনুসারীরা। কড়াইল বস্তির ২০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঢাকার বনানী থানার অধীন কড়াইল বস্তির পুরো এলাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। বনানীর ওয়্যারলেস দিয়ে কিছুটা ভেতরে ঢুকতেই কড়াইলের বেলতলা বস্তি। এই এলাকা পড়েছে ২০ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে রয়েছে প্রায় তিন হাজার ঘর। এ ঘরগুলো থেকে মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা ভাড়া তোলা হয়। ভাড়া তোলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির ও তাঁর অনুসারীরা। বস্তির বাকি ঘরগুলো পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে, যার কাউন্সিলর মফিজুর রহমান। মফিজুর রহমান ও তাঁর অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ঘর। সেখান থেকে প্রতি মাসে ভাড়া তোলা হয় প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ১০ হাজার দোকান থেকে মাসে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ভাড়া তোলা হয়। এ টাকাও দুই কাউন্সিলর ও তাঁদের অনুসারীরা ভাগাভাগি করে নেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কড়াইল বস্তি নিয়ন্ত্রণে দুই কাউন্সিলরের ১৫ জন অনুসারী রয়েছেন, যাঁরা বস্তিতে অবৈধ পানি ও বিদ্যুৎ–গ্যাসের সংযোগ দিয়ে ভাড়া তোলেন। ঘর ভাড়ার বাইরে একজন ভাড়াটেকে একটি বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহারের জন্য দিতে হয় ২৫০ টাকা, বৈদ্যুতিক পাখার জন্য ২৫০, পানির জন্য ২৫০, ফ্রিজ চালাতে ৭০০, টিভির জন্য ২৫০ ও ডিশ সংযোগের জন্য দিতে হয় ২৫০ টাকা।

‘তাসলিমার মাদক–সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আগে শোনা যেত। এখন তিনি এসবের সঙ্গে জড়িত নন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মহিলা যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাসলিমা। তাঁকে আমি চিনি।’
মফিজুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর

কড়াইল বস্তি এলাকায় ভাঙারির ব্যবসা করেন মো. কাশেম। তিনি বলেন, ঘর ভাড়া মাসের ১০ তারিখের মধ্যে মফিজ কাউন্সিলরের লোকজন এসে নিয়ে যান। সময়মতো দিতে না পারলে জোটে মারধর।

আরও পড়ুন

বস্তির এক বাসিন্দা বলেন, তিন মাস আগে ভাড়া দিতে দেরি হওয়ায় মফিজ কাউন্সিলরের লোকেরা তাঁর বাসার পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তিন মাসের সন্তানকে নিয়ে প্রায় ১৫ দিনের মতো তাঁকে অন্ধকারে থাকতে হয়।

অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে টাকা তোলার অভিযোগের বিষয়ে মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি এই এলাকার দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এসব ছড়াচ্ছেন।’

তাসলিমার নিয়ন্ত্রণে বস্তির মাদক কারবার

কড়াইল বস্তিকেন্দ্রিক মাদক কারবারেও জড়িত দুই কাউন্সিলরের অনুসারীরা। প্রথম আলোর অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, বস্তিতে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন তাসলিমা। তিনি কাউন্সিলর মফিজুরের ঘনিষ্ঠ। নিজেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে পরিচয় দেন তাসলিমা। মফিজুরের ঘনিষ্ঠ হলেও মাদক কারবার চালাতে আরেক কাউন্সিলর মো. নাছিরকেও টাকার ভাগ দেন।

বস্তির বিদ্যুৎ থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন শ রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। প্রতি ব্যাটারি বাবদ মাসে ১ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হয়। এ টাকা তোলেন কাউন্সিলর মো. নাছিরের অনুসারীরা।
বস্তির একজন বাসিন্দা

স্থানীয় লোকজন জানান, ২০ বছর আগে নরসিংদী থেকে ঢাকায় এসে কড়াইল বস্তিতে বসবাস করেছিলেন তাসলিমা। শুরুতে বনানীর একটি হোটেলে তরকারি কোটার কাজ করতেন তিনি। একসময় হোটেলের কাজ ছেড়ে বস্তিতে মাদক বিক্রি শুরু করেন। মাদকসহ একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও জড়িয়েছেন মাদক কারবারে। একপর্যায়ে মাদক কেনাবেচার জন্য নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন। তিন বোন ছাড়াও তাঁর বাহিনীতে রয়েছে আরও ছয়জন, যাঁরা মাদকসহ হত্যা মামলার আসামি। বর্তমানে তাঁর নামে একাধিক মামলা রয়েছে।

আরও পড়ুন

সংশ্লিষ্ট সূত্রের ভাষ্য, কড়াইল বস্তিতে মাদক কারবার চালাতে তাসলিমা স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজুরকে প্রতি মাসে দেন ৭ লাখ, আরেক কাউন্সিলর নাছিরকে দেন দুই লাখ। তাসলিমা মাদক ব্যবসা করে গুলশান ও বাড্ডা এলাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাসলিমার মাদক–সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আগে শোনা যেত। এখন তিনি এসবের সঙ্গে জড়িত নন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় মহিলা যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাসলিমা। তাঁকে আমি চিনি।’

তাসলিমার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির বলেন, তাসলিমা ইয়াবা কারবারসহ নানা অপরাধে জড়িত। বস্তিতে তাঁর পাঁচ শর মতো ঘর রয়েছে। তিনি সব সময় তাসলিমার কাজের বিরোধিতা করে এসেছেন।

বস্তিতে খুনোখুনি

পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১০ বছরে কড়াইল বস্তিতে ছয়টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। মাদক ব্যবসা, বস্তির ঘরের ভাড়া ও অবৈধ গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির টাকা তোলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে এসব ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ গত মাসে বস্তির নিয়ন্ত্রণ ও ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়াকে ঘিরে প্রতিপক্ষের হামলায় আল আমিন নামের এক যুবলীগ কর্মী নিহত হন। এই আল আমিনও ছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর মফিজুর রহমানের অনুসারী। যাঁরা আল আমিনের ওপর হামলা করেছেন, তাঁরাও মফিজুরের লোক।

এর আগে বস্তিতে গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী ও কড়াইল বস্তির একটি ইউনিটের ছাত্রলীগ সভাপতি রাকিব হাসান খুন হন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বস্তিতে রাকিবের কয়েকটি ঘর ছিল। সেখানে তিনি বৈধ বিদ্যুতের মিটার বসানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কাউন্সিলর মফিজুরের অনুসারীরা তাঁর ওপর হামলা করেন। তাঁদের হামলায় রাকিব মারা যান।

‘আমার ওয়ার্ডের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে অনেকের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন আমার বিরুদ্ধে বলছে।’
মো. নাছির, কাউন্সিলর

যাঁদের হাতে বস্তির গ্যাস–বিদ্যুৎ, পানির নিয়ন্ত্রণ

স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, বস্তির কোনো মালিকের রয়েছে ৩টি ঘর, কারও ৩০০টি। তবে অধিকাংশ মালিকই বস্তির বাইরে থাকেন।

বস্তিতে ১০টি ঘরের মালিক মঞ্জুর হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাড়া দেওয়া ঘরগুলোর গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ অন্য বাসা থেকে নিয়েছেন। তিনি বিলের টাকা তাঁদের দেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বস্তিতে অবৈধ গ্যাস–বিদ্যুৎ, পানির সংযোগ দেওয়া ও দুই কাউন্সিলরের পক্ষে টাকা তোলেন ১৫ ব্যক্তি। কড়াইল বস্তিতে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, তাঁতী লীগের ১৪টি কমিটি রয়েছে। দুই কাউন্সিলরের অনুসারীরাই এসব কমিটির বিভিন্ন পদে রয়েছেন। কাউন্সিলর মফিজুর রহমানের পক্ষে টাকা তোলেন শিপন, রফিক, টারজান, জুয়েল, নুরু, সেলিম ঢালী, গ্যাস রাসেল, কারেন্ট আলমগীর, শামসু, মোমিন। আর কাউন্সিলর মো. নাছিরের পক্ষে টাকা তোলেন নায়েব আলী, জুনায়েদ, সোহাগ, মতি, শরিফ।

বস্তির একজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, বস্তির বিদ্যুৎ থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন শ রিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয়। প্রতি ব্যাটারি বাবদ মাসে ১ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হয়। এ টাকা তোলেন কাউন্সিলর মো. নাছিরের অনুসারীরা।

অভিযোগ অস্বীকার করে কাউন্সিলর মো. নাছির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের বৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে অনেকের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন আমার বিরুদ্ধে বলছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দুই কাউন্সিলরের লোকজন অবৈধ গ্যাস–বিদ্যুৎ, পানির সরবরাহ করেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ওয়াসার ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘আমরা সরকারি লোক, অনেক কথা বলা যায় না। যাঁরা বস্তিতে অবৈধ পানির সংযোগের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা কাউন্সিলরদের আশপাশেই ঘোরাঘুরি করেন।’

ওয়াসার কর্মকর্তাদের অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তম কুমার রায় বলেন, ‘আমি বস্তিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জড়িতদের নাম চেয়েছি। আমি বলেছি, গোপনে আপনারা আমাকে নামগুলো বলুন, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানা যায়, পুরো কড়াইল বস্তিতে বৈধ মিটার আছে মাত্র ১৮টি। বাকি সব চলে অবৈধভাবে।

বস্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক  মো. কায়সার আমীর আলী ও তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন অর-রশীদ মোল্লা। বৈধ সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।