চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাং বেপরোয়া, ২ মাসে ৫ খুন
চট্টগ্রামে তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি করছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এদের হামলায় দুই মাসে (৫ এপ্রিল থেকে ৮ জুন) পাঁচটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের তালিকায় থাকা কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ‘বড় ভাই’রা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় অপরাধ থামছে না।
পুলিশ বলছে, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে এদের এমন অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ—সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গত বুধবার গোলাম রসুল নিশান নামের এক কিশোর গ্যাং নেতা দন্তচিকিৎসক কুরবান আলী খুনের মামলায় আত্মসমর্পণ করতে যান ৫০–৬০ জন অনুসারী নিয়ে। জামিন নামঞ্জুরের পর কারাগারে নেওয়ার সময় পুলিশের উপস্থিতিতে তারা হইচই করে এবং গণমাধ্যমকর্মীদের বাধা দেয়।
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুলিশ উঠোন বৈঠকসহ নানাভাবে মানুষকে সচেতন করছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িতদের বেশির ভাগকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আর যারা বেরিয়ে এসেছে, তাদের নজরদারিতে রেখেছে।চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়
সর্বশেষ ৮ জুন নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে মোটরসাইকেলের বিকট শব্দে হর্ন দেওয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের পর স্থানীয়ভাবে মীমাংসা হয়। এর দেড় ঘণ্টা পর আবার এক পক্ষের ওপর আরেক পক্ষ হামলা ও ছুরিকাঘাত করে। এতে একজন নিহত ও আরেকজন আহত হয়। এ ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাত আসামির বয়স ২০ থেকে ২২।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বন্ধে পুলিশ উঠোন বৈঠকসহ নানাভাবে মানুষকে সচেতন করছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িতদের বেশির ভাগকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আর যারা বেরিয়ে এসেছে, তাদের নজরদারিতে রেখেছে। পৃষ্ঠপোষক ‘বড় ভাই’দের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ইতিমধ্যে কয়েকজন পৃষ্ঠপোষক জামিনে রয়েছেন।
পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, পরিবার, সমাজ সবার সহযোগিতা ছাড়া এটি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সন্তান ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কি না, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।
পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ ‘বড় ভাই’। নগরে ২০০ কিশোর গ্যাং এখনো সক্রিয়। এদের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। গত ছয় বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪০টি।
গত ৫ এপ্রিল নগরের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ আবাসিক এলাকায় দন্তচিকিৎসক কুরবান আলীকে পিটিয়ে আহত করেন সদস্যরা। তাঁর মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে আলী রেজাকে বাঁচাতে এসে তিনি হামলার শিকার হন।
খুনের যত ঘটনা
নগরের পতেঙ্গার মনিরুজ্জামান রাফির জন্মের পর তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় নানাবাড়িতে মায়ের সঙ্গে থাকতেন রাফি। একমাত্র সন্তানকে বুকে আগলে রেখেছিলেন মা। মায়ের স্বপ্নপূরণে নগরের ইপিজেডে একটি পোশাক কারখানায় চাকরিও পান রাফি। কিন্তু মায়ের হাতে ঈদের বোনাসের টাকা তুলে দেওয়ার আগেই ছুরিকাঘাতে খুন হন রাফি।
ঘটনাটি ৮ জুন রাতের। বন্ধুদের সঙ্গে পতেঙ্গা সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। মোটরসাইকেলের সাইলেন্সার পাইপের বিকট শব্দকে কেন্দ্র করে বন্ধু জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা–কাটাকাটি ও মারামারি হয় রাফির। তাৎক্ষণিক মীমাংসার পর তাঁরা যে যাঁর মতো চলেও যান। কিন্তু দেড় ঘণ্টা পর ভোর সাড়ে চারটার দিকে জাহিদুল তাঁর লোকজন নিয়ে হামলা করে রাফির ওপর। ছুরিকাঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।
নগর পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) শাকিলা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনায় জড়িতদের বেশির ভাগই সদ্য কৈশোর পেরিয়ে উঠতি বয়সের তরুণ। এরা গভীর রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করে, মারামারি করে।
রাফির মা জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের বোনাসের টাকা হাতে তুলে দেওয়ার আগেই ছেলে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে লাশ হলো। জড়িতদের কঠোর শাস্তি চাই।’
নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ এলাকায় দুই পাড়ার কিশোরদের মধ্যে এক অটোরিকশাচালককে মারধরের জেরে পূর্ববিরোধ ছিল। এ ঘটনার জেরে ৩ জুন রাতে আগ্রাবাদের চারিয়াপাড়া বরফকল এলাকায় ১৫–২০ জনের একটি দল এসে ছুরিকাঘাতে খুন করে নুরুল আজিম (১৭) নামের এক কিশোরকে। সে একটি জাহাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত।
ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফজলুল কাদের পাটোয়ারী বলেন, পাড়াভিত্তিক দ্বন্দ্বের জেরে আজিমকে একা পেয়ে খুন করা হয়। ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরিসহ চার কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের মারামারিতে নিরীহ পথচারী মেহেদী হাসান নামের এক কারখানাশ্রমিক গত ৯ মে নগরের ইপিজেড আকমল আলী রোডে মারা যান।
কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হয়ে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন একাদশ শ্রেণির ছাত্র ওমর ফারুক। ৩ জুন নগরের পাহাড়তলী ভেলোয়ার দিঘির উত্তর পাড় এলাকায় ইয়াবা কেনার টাকা না পেয়ে মা রিনা আক্তারকে কুপিয়ে খুন করেন এই ছেলে। ওমর ফারুকের বাবা আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেষ্টা করেও ছেলেকে কিশোর গ্যাং থেকে ফেরাতে পারিনি, শেষ পর্যন্ত মাকেই খুন করল।’
গত ৫ এপ্রিল নগরের আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ আবাসিক এলাকায় দন্তচিকিৎসক কুরবান আলীকে পিটিয়ে আহত করেন সদস্যরা। তাঁর মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে আলী রেজাকে বাঁচাতে এসে তিনি হামলার শিকার হন। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১০ এপ্রিল চিকিৎসক কুরবান আলী মারা যান। এ ঘটনায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে আকবর শাহ থানায় হত্যা মামলা হয়। গোলাম রসুলসহ কারাগারে আছেন পাঁচজন। অন্যদের কেউ পলাতক, কেউ জামিনে।
গোলাম রসুল ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহসভাপতি। মামলার বাদী ও নিহতের ছেলে আলী রেজার অভিযোগ, জামিনে থাকা আসামিরা এলাকায় মহড়া দিচ্ছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের ভয় দেখানো হচ্ছে। তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হওয়ায় কিশোরেরা আদর্শহীনভাবে বেড়ে উঠছে, এমনটা মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ কুণ্ডু। তিনি বলেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে, পরিবারকে অবশ্যই সে খেয়াল রাখতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় প্রভাব বাড়ানোর জন্য যারা কিশোরদের হাতে অস্ত্র, মাদক তুলে দিচ্ছে, এখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পৃষ্ঠপোষক বড় ভাইদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে সবাইকে তার খেসারত দিতে হবে।