দুই পুলিশ সদস্যের দেওয়া ভুল ও মিথ্যা তথ্যের কারণে কক্সবাজারের দুই শিক্ষকের পরিবারের ১০ জনের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। এরপর ৪ বছরে এই দুই পরিবারের সদস্যদের ২০ থেকে ২৫ বার ঢাকায় আসতে হয়েছে, স্থানীয় পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয়েছে শতবার। তাঁদের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত হয়েছে ১২ বার। অফিস-বাড়ি কিংবা রাস্তায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ জন্য পরিবারগুলোর সন্তানদের মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে তাঁরা আত্মীয়স্বজনের কাছে নিন্দিত হয়েছেন। এত দিন পর এসে ওই দুই পুলিশ সদস্য বলছেন, অন্যদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তাঁরা ওই সব ভুল তথ্য দিয়েছিলেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশ ভেরিফিকেশন (যাচাই-বাছাই) থেকে শুরু করে পাসপোর্ট আবেদন ফরম পূরণ, ফি পরিশোধ, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই কক্সবাজারের দারুস সালাম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক নুরুল আলম ও মোহাম্মদ তৈয়ব জালালের পরিবারের ১০ জনকে পাসপোর্ট দেওয়া হয়। তাঁরা পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য ২০১৭ সালে পাসপোর্টের জন্য কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আবেদন করেন ও পাসপোর্ট পান। পাসপোর্ট পেয়ে নুরুল আলম ওমরাহ পালন করে আসেন। হঠাৎ ২০২০ সালের একদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভুয়া আইডিতে পোস্ট করা কাগজে দেখা যায়, তাঁদের পাসপোর্টের ছবি, সেখানে লেখা ‘ক্যানসেলড’। এর পর থেকেই দুই পরিবারের সদস্যদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ছুটতে থাকেন কক্সবাজার ও ঢাকার পাসপোর্ট অধিদপ্তরে। তখন তাঁদের জানানো হয়, তাঁরা আর পাসপোর্ট ফেরত পাবেন না। কেউই অবশ্য তাঁদের কারণ জানাননি। একাধিকবার কক্সবাজার ও ঢাকার কার্যালয়ে আবেদন করলেও কেউ তাঁদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। উল্টো দুই পরিবারকে নিয়ে চলেছে একের পর এক তদন্ত।
প্রায় চার বছর দৌড়ঝাঁপের পর নুরুল আলম ও মোহাম্মদ তৈয়ব হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। হাইকোর্ট পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পাসপোর্ট বাতিল আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে আপিল করেন। তখন আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন। সর্বশেষ পাসপোর্ট অফিস পুনরায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদপ্তরকে (এনএসআই) দিয়ে দুই পরিবারের বিষয়ে তদন্ত করায়। এনএসআইয়ের তদন্তের পর পাসপোর্ট অধিদপ্তর আগের পাসপোর্ট বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করে।
দুই পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্টের আবেদনের তথ্য যখন যাচাই-বাছাই করেছিলেন, সে সময় কক্সবাজারে পুলিশের বিশেষ শাখার দায়িত্বে ছিলেন এস এম মিজানুর রহমান। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজমের ইনভেস্টিগেশন বিভাগে পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) পদে কর্মরত। মিজানুর রহমানের সঙ্গে এই যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন মো. দেলোয়ার হোসেন নামের আরেক পুলিশ সদস্য। তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে সবার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। এই পুলিশ কর্মকর্তারাই গত বছরের ২৯ এপ্রিল পাসপোর্ট বাতিলকরণসংক্রান্ত এর আগে পাঠানো প্রতিবেদন বাতিল করে ওই ব্যক্তিদের পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (ডিএসবি) বরাবর আবেদন করেছেন।
আবেদনে তাঁরা লিখেছেন, কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনকালে ২০১৮ সালে তাঁদের নুরুল আলম ও মোহাম্মদ তৈয়বের সন্তানসহ দুই পরিবারের ১০ জনের পাসপোর্টের আবেদন অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। দায়িত্বভার গ্রহণ করে পাসপোর্ট প্রার্থীদের ঠিকানায় সশরীর উপস্থিত হয়ে আবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান করেন। এই ১০ জনের পিতার স্মার্ট কার্ড, প্রার্থীর স্মার্ট কার্ড, এনআইডি কার্ড, প্রার্থীর মায়ের মুত্যুসনদ, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের প্রত্যয়নপত্র, হালনাগাদ ভোটার তালিকা, স্থাবর সম্পত্তির দালিলিক কাগজপত্রের ফটোকপি, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদসহ স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশি মর্মে প্রাথমিকভাবে জানতে পারেন। প্রার্থীদের দাখিল করা দালিলিক কাগজপত্র ও দলিল–দস্তাবেজ পর্যালোচনায় এবং স্থানীয় অনুসন্ধানের আলোকে প্রার্থীদের পক্ষে পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য মতামত দিলে তাঁরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পান। পরে তাঁরা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ১০ জনের পাসপোর্ট বাতিলের জন্য কক্সবাজার পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় আবেদন করেন। তাঁদের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে ২০২০ সালের ৭ আগস্ট ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর পাসপোর্টগুলো বাতিল করে দেয়।
এই পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পাসপোর্টগুলো দেওয়ার বিষয়ে প্রথমে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন, সেটিই সঠিক ও যথাযথ ছিল। পরে ওই পাসপোর্ট প্রার্থীদের শত্রুরা তাঁদের নিজেদের পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে মিথ্যা তথ্য দিলে তাঁদের ‘সরল বিশ্বাসে বিশ্বাস করে’ পাসপোর্ট প্রার্থীদের পাসপোর্টগুলো বাতিলের জন্য আবেদন করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে পরবর্তী প্রতিবেদনটি সঠিক নয়। প্রথমে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন, সেই প্রতিবেদনটি সঠিক ও যথাযথ ছিল। তাই পাসপোর্টগুলো বাতিলের যে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছিল, সেটি গ্রহণ না করে প্রথমে যে প্রতিবেদন দাখিল দেওয়া হয়েছিল, সেটা গ্রহণের অনুরোধসহ প্রার্থীদের পাসপোর্টগুলো ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করেন।
পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার পর চার বছর ধরে যে হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা প্রথম আলোর কাছে তুলে ধরেছেন দারুস সালাম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ নুরুল আলম ও মোহাম্মদ তৈয়ব। তাঁরা জানান, কোনো উপায় না পেয়ে তাঁরা এই দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করেন। এর সপ্তাহখানেক পর মিজানুর ফোন করে তাঁকে (নুরুল আলম) চট্টগ্রামে যেতে অনুরোধ করেন। তিনি চট্টগ্রামে গেলে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে পাসপোর্ট বাতিল আদেশের কপি হাতে দেন। পাসপোর্ট বাতিল আদেশ ঘিরে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা করে। এরপর একের পর এক তদন্ত দেওয়ায় তাঁরা সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হন।
নুরুল আলম বলেন, ‘আমার ছোট ছোট বাচ্চাদের ক্লাসের সহপাঠীরাও ভিন্ন চোখে দেখত। একটি পরিবারের বিষয়ে যদি ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিএসবি ও লোকাল পুলিশ তদন্তের পর তদন্ত করতে থাকে, তখন সমাজের কাছে মিথ্যাও সত্যে পরিণত হয়। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।’ এর একপর্যায়ে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পান জানিয়ে তিনি বলেন, এসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একদিকে লাখ লাখ টাকা খরচ, অন্যদিকে সম্মানহানি হয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং এনএসআইয়ের তদন্তের পর পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সাদ্দাম হোসেন গত বছর ১৯ জুন কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালককে চিঠি দিয়ে দুই পরিবারের সদস্যদের পাসপোর্ট দিতে বলেন। তবে তাঁর পাসপোর্ট ফিও পরিশোধ করতে বলা হয়।
নুরুল আলম ও মোহাম্মদ তৈয়ব জানান, গত মার্চে একটি এবং তার কিছুদিন আগে–পরে তাঁরা সাতটি পাসপোর্ট পেয়েছেন। কিন্তু তিনজনের পাসপোর্ট দিতে রাজি হচ্ছে না পাসপোর্ট অধিদপ্তর। তারা বলছে, তাঁদের সন্তানদের ১৮ বছর হলে তবেই তাঁরা পাসপোর্ট পাবেন।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহপরিচালক মোবারক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
পাসপোর্ট নিয়ে দুই পরিবারের হেনস্তার শিকার হওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথম আলোর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যে বা যারা এই দুটি পরিবারকে হেনস্তা করেছে, তাদের প্রত্যেককে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। পাসপোর্ট পাওয়া যেকোনো নাগরিকের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার।’