ইডেন মহিলা কলেজ
চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্যে ছাত্রলীগ
এত দিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্য ও আপত্তিকর ভিডিও ধারণের অভিযোগ করতেন। এখন অভিযোগ করছে ছাত্রলীগই।
ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্য ও ছাত্রীদের দিয়ে জোর করে অনৈতিক কাজ করানোর যেসব কানাঘুষা ছিল, তা এবার প্রকাশ্যে এল ছাত্রসংগঠনটির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। ছাত্রলীগের বড় অংশ বলছে, তাদের নেত্রীরাই এসব অপরাধে জড়িত।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, সাধারণ ছাত্রীদের আপত্তিকর ছবি তুলে রেখে তাঁদের অনৈতিক কাজ অথবা আসন ছাড়তে বাধ্য করা। কখনো কখনো আপত্তিকর ছবি ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীদের কাছ থেকে টাকাও আদায় করা হয়।
কলেজটির একটি ছাত্রীনিবাসে গত আগস্টেও দুই ছাত্রীকে একটি কক্ষে আটকে রেখে তাঁদের এই বলে হুমকি দেওয়া হয় যে তাঁদের বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হবে এবং তা ছড়িয়ে দেওয়া হবে। অভিযোগটি ওঠে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ওরফে রীভার বিরুদ্ধে। এ হুমকির ঘটনার একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনা হয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এখনো নেয়নি। এবার ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস গত রোববার অভিযোগ করলেন, তাঁর আপত্তিকর ছবি তুলে রেখেছেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না ও সাধারণ সম্পাদকের রাজিয়া সুলতানার অনুসারীরা।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ২৫ নেত্রী গত রোববার কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং আট দফা দাবি করেছিলেন, তার বেশির ভাগই ছিল কলেজ ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বের চাঁদাবাজি, আসন–বাণিজ্য ও ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসংক্রান্ত। পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও সংঘর্ষের ঘটনায় সভাপতি তামান্না ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হওয়া ২৫ নেত্রীর মধ্যে ১২ জনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সঙ্গে বহিষ্কার করা হয় তাঁদের চার কর্মীকে।
ইডেন কলেজে গতকাল সোমবার আগের মতো উত্তপ্ত পরিস্থিতি ছিল না। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অথবা তাঁদের অনুসারীদের কলেজে মহড়া দিতে দেখা যায়নি। আর তাঁদের বিরোধীরা ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি করেন। পরে বেলা পৌনে একটার দিকে তাঁরা অনশন কর্মসূচি পালন করতে যান ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে। অবশ্য সেখানে তাঁরা এক ঘণ্টার বেশি থাকেননি। আমরণ অনশন কর্মসূচিও পালন করেননি।
বহিষ্কৃত সহসভাপতি জান্নাতুল ফেরদৌস আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো বড় ভাইদের জানাতে এসেছিলাম। জানিয়ে এখন চলে যাচ্ছি। সমস্যা সমাধানে তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা কোনো অনশনে নেই। আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই।’
ঐতিহ্যের কলেজে ‘লজ্জাজনক’ কর্মকাণ্ড
ইডেন দেশের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী কলেজের একটি। কলেজটির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজে এখন ছাত্রীর সংখ্যা ৩৫ হাজারের মতো। ছাত্রীদের জন্য ছয়টি ছাত্রীনিবাস আছে, যেগুলোতে আসনসংখ্যা ৩ হাজার ৩১০। বর্তমানে ছাত্রীনিবাসগুলোতে থাকছেন আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ছাত্রীনিবাসের বেশির ভাগ আসন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এটা শুধু এখনকার চিত্র নয়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রীনিবাসের আসন নিয়ন্ত্রণে রাখে।
অবশ্য ছাত্রীদের দাবি, বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ মাত্রা ছাড়িয়েছে। নির্যাতনের সময় আপত্তিকর ভিডিও করে রাখা ও ছবি তুলে রাখার প্রবণতা এই নেতৃত্বের সময় দেখা যাচ্ছে। সাধারণ ছাত্রীরা এ নিয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। কারণ, মুখ খুললে একদিকে তাঁদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে, অন্যদিকে এসব নিয়ে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। অবশ্য ছাত্রলীগ নেত্রীরা ও অন্য ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা এসব নিয়ে কথা বলা শুরু করেছেন।
নুসরাত কেয়া নামের ইডেন কলেজের স্নাতকের এক ছাত্রী গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। ‘ইডেন কলেজে ছাত্রলীগ নেত্রীদের দ্বারা ছাত্রীদের যৌন হেনস্তা, হুমকি, সিট–বাণিজ্য ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং নির্যাতকদের বিচারের দাবিতে’ ছাত্র অধিকার পরিষদ এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
নুসরাত কেয়া ছাত্র অধিকার পরিষদের সহসভাপতি। তিনি বলেন, তিনি ছাত্রলীগের এক নেত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ১২ হাজার টাকা দিয়ে ছাত্রীনিবাসে উঠেছিলেন। ওঠার পর সেখানে মেঝেতে ঘুমাতে হয়। এক কক্ষে ছিলেন ১২ থেকে ১৩ জন। খারাপ পরিস্থিতি ও নির্যাতনের কারণে তিনি ছাত্রীনিবাসে টিকতে পারেননি। তিনি আরও বলেন, ‘পরে শিক্ষকদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমি একটি লিগ্যাল (বৈধ) সিটে উঠি। কিন্তু সেখানেও থাকতে পারছি না। সেখানেও তারা মেয়েদের ওপর নির্যাতন করে। ছাত্রীদের খারাপ ভিডিও ধারণ করে তারা (ছাত্রলীগ) বলে যে সিট ছেড়ে না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’
নুসরাত কেয়া আরও বলেন, এককালীন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে ছাত্রলীগের নেত্রীরা তাঁদের নিয়ন্ত্রিত আসনে ছাত্রীদের ওঠান। এরপর প্রতি মাসে তাঁদের কাছ থেকে দুই হাজার টাকা করে নেন। চাঁদাবাজি নিয়মিত ঘটনা। তিনি বলেন, ছাত্রীনিবাসে সাধারণ ছাত্রীরা নিজেদের সম্মান ধরে রাখতে পারেন না। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়ার মতো নেত্রী ইডেন কলেজে থাকলে কলেজের হারানো সম্মান কোনো দিন ফিরে আসবে না। শুধু তাঁরাই নন, আরও অনেক নেত্রী এসব কাজে জড়িত।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধীরা গত রোববার সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের বিরুদ্ধে কলেজের ক্যানটিন, ইন্টারনেট সেবা ও মুদিদোকানে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলেন। তাঁদের আট দাবির একটি ছিল, ছাত্রীদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করা। এমনকি গত শনিবার রাতে বিক্ষোভের সময় এক ছাত্রীর হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, অনৈতিক কাজে যুক্ত নেত্রীকে চাই না।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরোধীরা গতকাল যে সংবাদ সম্মেলন করেন, সেখানে বহিষ্কৃত সহসভাপতি সুস্মিতা বাড়ৈ বলেন, ‘এমন বিষয় আমাদের কানেও বারবার আসে যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তাঁদের মেয়েরা নাকি কাজ নিয়ে আসে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করে...।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইডেনে যাঁর শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে, তিনিই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। আসন–বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির স্বার্থের কারণেই তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অপতৎপরতা চালান।
ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রীদের অনেকেরই ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে। কেউ কেউ নানা কৌশলে ছাত্রত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। এমনকি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে যাঁরা বিক্ষোভ করছেন, তাঁদের অনেকেরই ছাত্রত্ব নেই। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন ইডেন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি এক যুগ ধরে ছাত্রীনিবাসে থাকেন। তামান্না চাঁদাবাজি ও আসন–বাণিজ্যের অভিযোগ গত রোববারের সংবাদ সম্মেলনে অস্বীকার করেন। গতকাল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গত আগস্টে ছড়িয়ে পড়া একটি অডিওতে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ইডেন কলেজে ‘ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কেউ নাই’। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে ক্ষমাও চান তিনি। যদিও ছাত্রলীগ তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
কলেজে প্রশাসন ‘থেকেও নেই’
ইডেন কলেজে প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে। তবে ছাত্রীরা বলছেন, এই প্রশাসন নামে মাত্র, নিয়ন্ত্রক ছাত্রলীগ। প্রশাসন এসব কর্মকাণ্ড যেমন বন্ধ করতে পারে না, তেমনি এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথাও বলে না। ছাত্রলীগের কোন্দলের কারণে কলেজে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হওয়া নিয়ে গত রোববার অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের কার্যালয়ে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা হয়েছে। তবে তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেননি। গতকাল তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করে কথা বলার চেষ্টা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুটি পক্ষের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব চলছে বলে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করতে নেতিবাচক ঘটনাগুলো সামনে আনছেন। কিন্তু এমন ঘটনা যে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘটে না, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না৷ নিশ্চয়ই অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তবতাও একই৷ তিনি বলেন, ছাত্ররাজনীতির সুস্থ ধারা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই৷ এর কারণ মূলধারার রাজনীতি এখন অসুস্থ, কোনো গণতন্ত্র নেই। মূল দলে জবাবদিহিহীনতার একটা প্রভাব ছাত্রসংগঠনের ওপরও পড়েছে।
তানজীমউদ্দিন খান আরও বলেন, সব মিলিয়ে ছাত্ররাজনীতিতে একধরনের অপরাধীকরণ ঘটেছে। এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে একটা মাস্তান চক্রের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করা হচ্ছে।