‘তুই কি নয়ন, গাড়িতে উঠ, আমরা পুলিশের লোক’

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর দোলাইরপাড়ে গত বছর এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৫৪ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পুলিশের এক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই), এক কনস্টেবলসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের এএসআই দেলোয়ার হোসেন ও কনস্টেবল আবু সায়েমের নেতৃত্বে একদল ডাকাত গত বছরের অক্টোবরে এক ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। পরে সেই টাকা তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এএসআই দেলোয়ারের বাসার ওয়ারড্রব থেকে ডাকাতির ১২ লাখ টাকা এবং কনস্টেবল সায়েমের ট্রাংক থেকে ৮ লাখ ৮৭ হাজার উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, ৯ বছর আগে এএসআই দেলোয়ারের নামে কেরানীগঞ্জ থানায় মাদকদ্রব্য আইনে মামলা হয়েছিল। সেই মামলার তিনি অভিযুক্ত আসামি। অন্যদিকে কনস্টেবল সায়েমের বিরুদ্ধে ১১ বছর আগে পল্টন থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। তিনিও সেই মামলার অভিযুক্ত আসামি।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ডাকাতির সময় এএসআই দেলোয়ার গুলশান থানায় কর্মরত ছিলেন। পরে ওই ঘটনায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর সায়েম আগে থেকে বরখাস্ত ছিলেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপপরিদর্শক (এসআই) মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ৮ অক্টোবর রাজধানীর দোলাইরপাড় মোড় থেকে এক ব্যবসায়ীর টাকা লুটের অভিযোগে তিনি এএসআই দেলোয়ার, কনস্টেবল সায়েমসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।

ডিবি আদালতকে জানিয়েছে, এএসআই দেলোয়ার ১৯৯৮ সালের ২৬ মে কনস্টেবল হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। আর সায়েম পুলিশে যোগ দেন ২০০৪ সালে।
অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, এএসআই দেলোয়ার, কনস্টেবল সায়েমসহ অন্যরা পুলিশ পরিচয়ে টার্গেট করা ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের গাড়িতে তুলে নিতেন।

এএসআই দেলোয়ারের বাসার ওয়ারড্রব থেকে ডাকাতির ১২ লাখ টাকা এবং কনস্টেবল সায়েমের ট্রাংক থেকে ৮ লাখ ৮৭ হাজার উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মামলার বাদী আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ী আবুল কালাম নগদ টাকা আনা-নেওয়া করতেন, সেটি জানতেন তাঁর ভাই কাজী মোশাররফ হোসেন। মোশাররফের দেওয়া তথ্যে সেদিন আবুল কালামের নাতি তানভীর হোসেন ওরফে নয়নকে পুলিশ পরিচয়ে মাইক্রোতে তোলেন এএসআই দেলোয়ার ও হানিফ কাজী। কনস্টেবল সায়েম আগে থেকে গাড়ির পেছনে বসা ছিলেন। তানভীরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় ৫৪ লাখ টাকা। তাঁর মুঠোফোনটি মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেন আসামিরা।

যেভাবে ধরা পড়েন দুই পুলিশ সদস্য

১৯ বছর বয়সী তানভীর তাঁর ব্যবসায়ী নানা আবুল কালামের কাছ থেকে ৫৪ লাখ টাকা বুঝে নেন। পরে ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে তিনি হাঁটতে হাঁটতে দোলাইরপাড় মোড়ে আসেন। এ সময় এক ব্যক্তি তাঁর পথ রোধ করেন। তাঁকে বলেন, ‘তুই কি নয়ন, গাড়িতে উঠ। আমরা পুলিশের লোক।’ তানভির বলেন, তখন দুই ব্যক্তি তাঁকে জোর করে মাইক্রোবাসে তোলেন।

তানভীর পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন, মাইক্রোবাসে চারজন ছিলেন। এর মধ্যে একজনের গায়ে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম। পরে তাঁরা ব্যাগভর্তি ৫৪ লাখ টাকা ও তাঁর মুঠোফোনটি ছিনিয়ে নেন। পরে মাইক্রোবাসটি মাওয়া সড়ক হয়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে যায়। পরে লাথি মেরে তাঁকে মাইক্রোবাস থেকে ফেলে দিয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা চলে যায়।

এএসআই দেলোয়ার হোসেন, কনস্টেবল সায়েম, আবুল বাতেনসহ অন্যরা সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সদস্য। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ধনী ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে আসছিলেন।

জবানবন্দিতে তানভীর আরও উল্লেখ করেন, মুন্সিগঞ্জ থেকে ফিরে নানা আবুল কালামকে সব ঘটনা খুলে বলেন তিনি। পরে আবুল কালাম শ্যামপুর থানায় অভিযোগ জমা দেন। গোয়েন্দা পুলিশ দোলাইরপাড় মোড়ের সিসিটিভির ফুটেজ জব্দ করে। পরে ভুক্তভোগী তানভীর গোয়েন্দা পুলিশ সদস্যদের জানান, ঘটনাস্থলে যাঁরা ঘোরাঘুরি করছিলেন, তাঁদের একজন হলেন তাঁর নানার ভাই কাজী মোশাররফ হোসেন।
তানভীরের তথ্যমতে, পুলিশ ব্যবসায়ী আবুল কালামের ভাই মোশাররফের বাসায় অভিযান চালায়। তাঁর বাসার ওয়ারড্রব থেকে ১২ লাখ টাকা জব্দ করে পুলিশ। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ আরও দুজনের নাম জানতে পারে। তাঁরা হলেন গুলশান থানার তৎকালীন এএসআই দেলোয়ার ও কনস্টেবল আবু সায়েম।

ভুক্তভোগী তানভীর পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে আরও উল্লেখ করেন, এএসআই দেলোয়ারকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর পল্টনের বাসা থেকে ডাকাতির ১২ লাখ টাকা উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল সায়েমকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ট্রাংক থেকে ডাকাতির ৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা জব্দ করে পুলিশ। আর মাইক্রোবাস চালক বাতেনের বাসার ওয়ারড্রব থেকে ৯ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, এএসআই দেলোয়ার হোসেন, কনস্টেবল সায়েম, আবুল বাতেনসহ অন্যরা সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সদস্য। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ধনী ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে আসছিলেন।

মামলার বাদী ব্যবসায়ী আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কল্পনাও করিনি, আমার ভাই মোশাররফ আমার এত বড় ক্ষতি করবেন। কিন্তু মোশাররফই পুলিশ দেলোয়ারসহ অন্যদের নিয়ে আমার নাতির কাছ থেকে ৫৪ লাখ টাকা ডাকাতি করেছিলেন। আমার ভাইসহ ডাকাতির ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’