‘আব্বা বাহিনী’র হাতে খুন, সেই মামলায় জড়ানো হচ্ছে নির্যাতনে এলাকাছাড়া তিন ভাইকে
ঢাকার উপকণ্ঠে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ‘আব্বা বাহিনী’র হাতে এক যুবক খুনের মামলায় আসামি করা হয়েছে তিন সহোদরকে। ওই হত্যাকাণ্ডে আব্বা বাহিনীকে তাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ পুলিশের। তবে তিন ভাইয়ের স্বজনেরা বলছেন, উল্টো তাঁরাই আব্বা বাহিনীর হামলার শিকার হয়ে দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া ছিলেন। নিহত যুবকের স্ত্রী ও মামলার বাদীও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি। হত্যাকাণ্ডে তাঁদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সন্দেহের কথাও তিনি বলেননি।
তিন সহোদরকে যে মামলার আসামি করা হয়েছে, সেটি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল হত্যাকাণ্ড। সাইফুলও আব্বা বাহিনীর সদস্য ছিলেন। চাঁদার টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জেরে গত ১০ জানুয়ারি রাতে তাঁকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়।
কথিত আব্বা বাহিনীকে নিয়ে প্রথম আলোতে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ‘বুড়িগঙ্গার ওপারে “আব্বা বাহিনী”’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই বাহিনীর প্রধান দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিন। পরিচালনায় ছিলেন তাঁর ছেলে আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বি। রাব্বি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ১২ জানুয়ারি তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সাইফুল ইসলাম হত্যার মামলায় আসামি এই তিন সহোদর হলেন আসাদুজ্জামান রনি, ফেরদাউস রহমান ওরফে বাবু ও আতাউর রহমান ওরফে সনি। এই মামলায় ২৭ ফেব্রুয়ারি আসাদুজ্জামান ও ফেরদাউসকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। আর আতাউর এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তিন ভাইয়ের পরিবারের ভাষ্য, শুভাঢ্যার চর মীরেরবাগ এলাকায় একটি জমি কেনার বিরোধকে কেন্দ্র করে গত বছরের এপ্রিলে তাঁদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিলেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। সেই টাকা না দেওয়ায় হামলা চালিয়ে তিন ভাইকে কুপিয়ে জখম করা হয়। পরে তাঁদের বাসায় লুটপাট চালিয়ে ২ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার লুট করেন আব্বা বাহিনীর সদস্যরা।
তিন সহোদরের মা আঁখি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী মিজানুর রহমান ও ছেলেরা এলাকায় ব্যবসা করতেন। আব্বা বাহিনীর হামলায় তিন ছেলেই গুরুতর আহত হন। প্রাণভয়ে তাঁর স্বামী ও ছেলেরা এলাকায় থাকতেন না। রাজধানীর শ্যামপুরে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। পূর্ববিরোধ ও রাজনৈতিক বিরোধ থেকে তাঁর ছেলেদের খুনের মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। বাছের উদ্দিনের (আব্বা বাহিনীর প্রধান) সঙ্গে যোগসাজশ করে পুলিশ তাঁর সন্তানদের খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে।
তিন সহোদর আসামি হলেন কীভাবে
হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসাদুজ্জামান শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর ভাই ফেরদাউস রহমান শুভাঢ্যা ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য। আতাউর রহমান শুভাঢ্যা ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সহসভাপতি। তাঁদের বাবা মিজানুর রহমান শুভাঢ্যা ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সহসভাপতি ছিলেন। চারজনের বিরুদ্ধে একাধিক রাজনৈতিক মামলাও রয়েছে।
বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় তিন সহোদরের আব্বা বাহিনীর হাতে যুবক খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মামলার এজাহারেও তাঁদের নাম ছিল না। এ নিয়ে পুলিশ বলছে, সাইফুল খুনের মামলায় আব্বা বাহিনীর মাঠের নেতা আফতাব উদ্দিন ওরফে রাব্বিসহ ১২ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের ছয়জনের জবানবন্দিতে তিন সহোদরের নাম এসেছে।
পুলিশের কেরানীগঞ্জ অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, খুনের সময় তিন ভাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন—জবানবন্দিতে এমন তথ্য আসার পরই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা আদালতে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেননি। তবে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে খুনের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
আব্বা বাহিনীর ‘হামলার শিকার’ হয়ে এলাকাছাড়া তিন ভাই এই বাহিনীর সহযোগী হিসেবে খুনে জড়িয়ে পড়লেন কীভাবে? জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, জবানবন্দিতে আসামিরা তাঁদের নাম বলেছেন। সে জন্য তাঁদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য দেননি।
এ বিষয়ে দুই দফায় কথা হয় মামলার বাদী নিহত সাইফুল ইসলামের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে। ১০ মার্চ যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রনি (আসাদুজ্জামান) ও বাবুকে (ফেরদাউস রহমান) গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের কথা জানেন না। তাঁদের তিনি চেনেন না।
রাসেলকে নির্যাতনের যে ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেখানে এই তিনজনের কাউকে দেখা যায়নি বলেও জানান মৌসুমী আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইফুলকে যারা হত্যা করেছে, তাদেরই ধরুক, তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। কাউকে বিনা দোষে বা ওরা (গ্রেপ্তার আব্বা বাহিনীর সদস্যরা) যদি নাম করে, যদি ধরে (গ্রেপ্তার) তবে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে।’
দ্বিতীয় দফায় ১৮ মার্চ মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসেলকে মারধর করার সময় অনেক লোক ছিল। যাদের কথা বলা হচ্ছে (তিন সহোদর), আসামিরা তাদের নাম (জবানবন্দিতে) বলেছে। আমি তো বলিনি। এ কারণে আমি কিছু বলতে পারব না।’
‘পরিবারটি আক্রোশের শিকার’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আব্বা বাহিনী। অপর দিকে মিজানুর রহমানের পরিবার বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয়। সে কারণে পরিবারটি আব্বা বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল বলে জানান স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এখন উল্টো আব্বা বাহিনীর অপরাধে পরিবারটির তিন ছেলেকে জড়ানোর বিষয়টিকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসাদুজ্জামান ও ফেরদাউসকে গ্রেপ্তারের দিন আব্বা বাহিনীর প্রধান বাছের উদ্দিনকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল হাসানের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে কেরানীগঞ্জ থানার সামনে পরামর্শ করতে দেখা গেছে। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে বাছের উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মিজানুর রহমানের ছেলেদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তাঁর কোনো ভূমিকা নেই। যেদিন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি অন্য কাজে থানায় গিয়েছিলেন। থানায় গিয়ে দুই সহোদরের সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই পরিবার আব্বা বাহিনীর আক্রোশের শিকার। বাছের উদ্দিন দীর্ঘদিন ধরেই পরিবারটির ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছেন। এবার মামলার মেরিট (বিষয়বস্তু) নষ্ট করার পাশাপাশি নিজের ছেলেকে বাঁচাতে পরিবারটিকে হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন।’
হামলা চালিয়ে লুট, এক বছর পর চুরির মামলা
শুভাঢ্যা ইউনিয়নে আব্বা বাহিনী বছরের পর বছর নানা অপকর্ম চালিয়ে এসেছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সাইফুল খুনের মামলায় আব্বা বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তারের পর এখনো এই বাহিনীর প্রতি নমনীয় আচরণ করছে পুলিশ। আব্বা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে দায়সারাভাবে মামলা নেওয়া হচ্ছে।
শুভাঢ্যার চর মীরেরবাগ এলাকায় এক যুগের বেশি সময় আগে জমি কিনে বাড়ি করেছিলেন ব্যবসায়ী আবিদ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মরিয়ম। পাঁচ শিশুসন্তান নিয়ে ওই বাড়িতেই থাকতেন তাঁরা। গত বছরের এপ্রিলে তাঁদের বাড়িতে হামলা করে লুটপাট চালান আব্বা বাহিনীর সদস্যরা। তিন দিন অবরুদ্ধ করে রাখা হয় পরিবারটিকে। তারপর তাঁদের এলাকাছাড়া করা হয়। মরিয়মের অভিযোগ, থানা-পুলিশ তখন আব্বা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেয়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশের পর পুলিশের সহায়তায় মরিয়ম বাড়িতে ফেরেন। মরিয়ম প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ি ফিরে পাওয়ার পর মামলা করতে গেলে থানা-পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি। পরে চুরির ধারায় মামলা নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের কেরানীগঞ্জ অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু আসামিরা ভুক্তভোগীর পরিচিত, এ কারণে ঘটনাটিকে ডাকাতি হিসেবে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। মামলায় চুরিসহ বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি অনেক দিন আগের হলেও ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে আসেননি। তিনি যখন এসেছেন, তখন পুলিশ মামলা নিয়েছে।
পুলিশের এ বক্তব্যের বিষয়ে মরিয়ম বলেন, তাঁর বাড়িতে হামলার সময় জরুরি সহায়তা নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করেছিলেন। পুলিশ তাঁদের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে। তখন পুলিশ তাঁর অভিযোগ নেয়নি। প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আব্বা বাহিনীকে বাঁচাতে দায়সারা মামলা নিয়েছে।