পরিবার নিয়ে না খেয়েও থাকতে হচ্ছে, তারপরেও জুয়া ছাড়তে পারছেন না তাঁরা

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

দিনভর অটোরিকশা (সিএনজি) চালিয়ে হাজার টাকা আয় করেন মো. আফছার মিয়া (ছদ্মনাম)। সেই টাকা নিয়ে রাজধানীর বাড্ডার আনন্দনগরের ঝিলপাড় এলাকায় সেলিম মাস্টারের গ্যারেজে গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জুয়া খেলেন তিনি। সেখান থেকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে বাসায় ফেরেন। টাকার অভাবে ঘরে বাজার থাকে না। বন্ধ হয়ে গেছে তিন সন্তানের লেখাপড়া। কিন্তু জুয়া খেলার প্রতিবাদ করলেই স্ত্রীকে মারধর করেন আফছার।

কেবল আফছার নয়, বাড্ডায় এমন জুয়ার আসরে প্রতি রাতে জুয়া খেলেন গাড়িচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা। পুলিশ ওই এলাকায় এমন ১০টি জুয়ার আসর শনাক্ত করেছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থানা-পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে এসব জুয়ার আসর চালান।

সিএনজিচালক আফছার গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, মাসে অন্তত ১৫ দিন জুয়া খেলে সব টাকা হারিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। ২৮ বছর ধরে ঢাকায় গাড়ি চালান। জুয়ার নেশার কারণে কোনো টাকা সঞ্চয় করতে পারেননি। কোনো কোনো দিন পরিবার নিয়ে না খেয়েও থাকতে হয় তাঁকে। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এত কিছুর পরও জুয়া ছাড়তে পারছেন না তিনি।

পুলিশ বলছে, অনেক পরিবারে কলহের কারণ জুয়া। জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটছে। গত বছরের নভেম্বরে বাড্ডা থানা এলাকায় ১০টি জুয়ার ‘স্পট’ ও জুয়া পরিচালনাকারী ব্যক্তিদের শনাক্ত করেছে পুলিশ। একটি চক্র কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ‘ম্যানেজ’ করে এসব জুয়ার আসর চালাচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েকটি জুয়ার আসর বন্ধ করে দিয়েছে।

পুলিশের একটি প্রতিবেদন ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাড্ডার সেলিম মাস্টারের গ্যারেজে জুয়ার আসর চালান মো. বাপ্পী নামের এক ব্যক্তি। তিনি থাকেন রাজধানীর মগবাজার এলাকায়। তিনি সরাসরি কোনো রাজনীতি না করলেও টাকা দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে রাখেন। প্রতিদিন রাত ১২টার পর সেখানে আসর বসে। কয়েকটি ভাগে ১৫ থেকে ২০ জন জুয়া খেলেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই গাড়িচালক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

শনিবার সেলিম মাস্টারের গ্যারেজে গিয়ে কথা হয় চার সিএনজি অটোচালক ও তিন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, জুয়ার আসর বসিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষকে নিঃস্ব করা হচ্ছে। প্রতিদিন ২০ জন জুয়া খেললে ৩ জন টাকা জিতেন। বাকি সবাই টাকা হারিয়ে বাসায় ফেরেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, বাপ্পীর সঙ্গে বাড্ডা এলাকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও বাড্ডা থানার কিছু পুলিশ সদস্যের সখ্য ছিল। জুয়ার আসর থেকে তাঁরা টাকার ভাগ পেতেন। পরে পুলিশ দুই সপ্তাহ আগে অভিযান চালিয়ে সেলিম মাস্টারের গ্যারেজের জুয়ার আসর বন্ধ করে দেয়। তবে বাপ্পী এখন অন্য জায়গায় জুয়ার আসর বসাচ্ছেন।

নিয়মিত জুয়া খেলেন এমন এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বাড্ডা এলাকায় দুই ধরনের জুয়ার আসর বসে। কোনো কোনো আসরে জুয়া খেলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেক অ্যাপার্টমেন্টে জুয়ার আসর বসে। সেখানে ধনী ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা জুয়া খেলেন।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গাজী ইয়াসিন শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চিহ্নিত জুয়ার আসরগুলো বন্ধ করতে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। নতুন করে কেউ কোথাও জুয়ার আসর বসাচ্ছে, এমন খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছি।’

বাড্ডার যে ১০ স্পটে চলে জুয়ার আসর

পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাড্ডা এলাকায় আট ব্যক্তি জুয়ার আসর চালান। মধ্য বাড্ডার বাজারগলি এলাকায় তিনটি জুয়ার আসর চালান ফিরোজ মোল্লার বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. জিল্লুর, গালকাটা কবির ও মো. ফিরোজ। মধ্য বাড্ডার ইউসুফ গলিতে দুটি জুয়ার আসর চালান মো. গনি মিয়া, আনন্দনগরে সেলিম মাস্টারের গ্যারেজে বাপ্পী, বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্টের ৭ নম্বর সড়কের ১৮ নম্বর প্লটে মো. মামুন, উত্তর বাড্ডার ময়নাবাগে মো. মাহবুব কাজী এবং সাঁতারকুলে মো. আলী জুয়ার আসর চালান। এ ছাড়া এলিন কমিউনিটি সেন্টারে অস্থায়ীভাবে একটি জুয়ার আসর চালানো হয়।

জুয়ার আসর পরিচালনাকারী আটজনের মধ্যে চারজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে তিনজন নিজেরা জুয়ার আসর পরিচালনার সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। গোপালগঞ্জের কাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পরিচয় দিয়ে মো. মাহবুব কাজী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা কয়েকজন মিলে বাজিতে তাস খেলতেন। তবে জুয়ার সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

জুয়ার আসর চালানোর কথা স্বীকার করে মো. বাপ্পী শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় তিনি জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। পরে তিনি নিজেই জুয়ার আসর চালান। তাঁর আসরে গাড়িচালকেরা জুয়া খেলতেন। থানা-পুলিশ কয়েক মাস আগে তাঁর জুয়ার আসরটি বন্ধ করে দেয়।

সাঁতারকুলের জুয়ার আসর পরিচালনাকারী মো. আলী দাবি করেন, জুয়ার আসর চালিয়ে তিনি সংসার চালাতেন। তাঁর আসরও পুলিশ বন্ধ করে দেয় বলে জানান। আরেক আসর পরিচালনাকারী জিল্লুরও জুয়ার আসর চালানোর কথা স্বীকার করেন।