দুবাই থেকে অবৈধভাবে আনা সোনা উদ্ধারে পুলিশকে দিয়ে এক যুবককে ধরে থানায় এনে পিটিয়েছিলেন সোনা চোরাকারবারি চক্রের নেতা। ঘটনাটি ঘটেছিল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানায়। এ বিষয়ে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, একজন ভিআইপির অনুরোধে সোনা উদ্ধারে ওই যুবককে ধরে আনা হয়েছিল। তারা জানত না ভিআইপি একজন সোনা পাচারকারীর জন্য ফোন করেছেন।
ভিআইপির কথা বললেও তাঁর নাম বলেনি পুলিশ। পরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে সেই ভিআইপির নাম পাওয়া গেছে। তিনি মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। থানায় বসে যুবককে মারধর করা ওই সোনা চোরাকারবারি সুলতান মিয়ার বাড়িও মৌলভীবাজারে।
প্রথম আলোর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুলতান আমার এলাকার ছেলে। দুবাই যাওয়া–আসা করে। তাঁর স্বর্ণ হারিয়েছে বলে আমার কাছে এসে বলেছিল। আমি পুলিশকে বলেছিলাম তদন্ত করে সত্য–মিথ্যা যাচাই করতে। আমি পুলিশকে বলিনি তাঁকে ওসি বানিয়ে চেয়ারে বসাতে।’
মন্ত্রী বলেন, সুলতান স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত, তা তিনি জানতেন না। তাঁকে সুলতান বলেছিলেন সোনাগুলো বৈধ, শুল্ক পরিশোধ করে আনা হয়েছে।
তবে গত বছর আগস্টের শেষ দিকে থানায় এ ঘটনার পর সেখানকার একজন সহকারী উপপরিদর্শককে সাময়িক বরখাস্ত এবং পরিদর্শককে (তদন্ত) বদলি করা হয়। তখনই মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ অনুসন্ধানে জানতে পারে, সুলতান মিয়া একজন সোনা চোরাকারবারি। দুবাই থেকে অবৈধভাবে দেশে সোনা পাঠান তিনি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের তথ্যমতে, বিমানবন্দর থানার একটি সোনা পাচারের মামলায় সুলতানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে এখন তিনি কারাগারে নাকি জামিনে আছেন, তা জানা যায়নি। মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, একজন ভিআইপি চোরাই সোনা উদ্ধারে তাঁদের অনুরোধ করবেন, সেটা তাঁরা বুঝতে পারেননি। সোনা উদ্ধারের পর পুলিশ ওই ভিআইপিকে মামলা করার অনুরোধ করলেও তিনি রাজি হননি।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মাদ গোলাম আজাদ খান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘একজন ভিআইপি অনুরোধ করে বলেছিলেন, তাঁর এক আত্মীয়ের বিয়ের জন্য দুবাই থেকে সোনার অলংকার পাঠানো হয়েছে। যাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন, তিনি স্বর্ণ বুঝিয়ে দেননি। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জে। পরে আমি পুলিশ দিয়ে ওই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করি। স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়।’
তবে পুলিশ শুধু দুবাই থেকে সোনা আনা যুবককে তুলেই আনেনি, তাঁকে নির্যাতন এবং চোরাকারবারিকেও মারধরের সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই ঘটনার একটি ভিডিও সম্প্রতি প্রথম আলোর হাতে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, থানার পরিদর্শকের কক্ষে টেবিলের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে আছেন এক যুবক। পাশে দাঁড়ানো কোমরে পিস্তল গোঁজা এক পুলিশ সদস্য। পরিদর্শকের চেয়ারে বসা সুলতান মিয়া ওই যুবককে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। হঠাৎ যুবককে কষে চড় মারেন পুলিশ সদস্য। এ সময় সুলতান মিয়া পরিদর্শকের চেয়ার থেকে উঠে এসে যুবককে মারধর শুরু করেন। যুবক মেঝেতে পড়ে গেলে পা দিয়ে তাঁর মাথা চেপে ধরে লাথি-ঘুষি মারতে থাকেন তিনি।
ওই যুবক দুবাই থেকে অবৈধভাবে সুলতানের সোনা নিয়ে আসা নাজমুল হাসান (৩০)। তাঁর বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার তিল্লি গ্রামে। চার লাখ টাকা খরচ করে গত বছর এপ্রিলে দুবাই গিয়েছিলেন তিনি। কাজ না পেয়ে চার মাস পর গত আগস্টে দেশে ফেরেন। বিমানের টিকিট কিনে দেন সুলতান মিয়া। শর্ত অনুযায়ী, সুলতানের দেওয়া দুটি স্বর্ণের বার এবং মোট ৯ ভরি ওজনের স্বর্ণের ৯টি চুড়ি বহন করতে হয় নাজমুলকে। কিন্তু দেশে ফিরে নাজমুল সেই স্বর্ণ সুলতানের লোকের কাছে পৌঁছে দেননি। এরপর সুলতানের হয়ে সেই স্বর্ণ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মানিকগঞ্জ পুলিশ।
মারধর করা পুলিশ সদস্য হলেন ওই থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) তারেক আজিজ। কয়েক মাস পর ঘটনাটি জানাজানি হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পাশাপাশি সুলতান মিয়া থানার মধ্যে যাঁর চেয়ার থেকে উঠে নাজমুলকে মারধর করেন, সেই পরিদর্শক (তদন্ত) মহব্বত আলীকে বদলি করা হয়। বর্তমানে কিশোরগঞ্জে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ওই ঘটনার আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সাটুরিয়া থানার ওসির কক্ষে সুলতান মিয়ার উপস্থিতিতে টাকার লেনদেন হচ্ছে। সেখানে পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
নাজমুল ও তাঁর স্বজনেরা জানিয়েছেন, সেখানে সবার উপস্থিতিতে সুলতান মিয়াকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে বিষয়টির দফারফা করা হয়। এর মধ্যে নাজমুল দিয়েছিলেন ছয় লাখ টাকা। আর বাকি টাকা দিয়েছিলেন নাজমুল ফেরার পর অবৈধ সোনাগুলো বিক্রি করে দেওয়া আমির নামের এক আদম ব্যাপারী। নাজমুল জানিয়েছেন, এই আমিরের মাধ্যমে দুবাইয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সোনা পাচারকারীর হয়ে পুলিশের এ ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তিগত লাভের আশায় ওই পুলিশ কর্মকর্তারা আইন ও প্রথাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। পুলিশে শৃঙ্খলার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।