বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে মাদক যায় বগুড়া জেলা কারাগারে, জড়িত ‘জেলবাবুরাও’
কারারক্ষীরা ‘জেলবাবু’ নামে পরিচিত। অনেক জেলবাবু সরাসরি মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
কনডেমড সেলের ছাদ ছিদ্র করে চার আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসা বগুড়া জেলা কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বলতার পাশাপাশি নানা অপরাধ ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। কারাগারের ভেতরে একটি চক্র মাদক সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জেলা কারাগারের একটি সূত্র বলছে, কারাগারের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালনকারী কারারক্ষীরা ‘জেলবাবু’ নামে পরিচিত। অনেক জেলবাবু সরাসরি মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত। কারাগারে মাদক যায় দুভাবে। একটি হচ্ছে কারাগারে কর্মরতদের মাধ্যমে। অন্যটি কারাগারের পশ্চিম পাশের দেয়ালের ওপার থেকে মাদক ছুড়ে ভেতরে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়া কারাগারের এক কারারক্ষী প্রথম আলোকে বলেন, মাদককে কেন্দ্র করে কারাগারের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে কারাগারের অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তাকে ব্লেড দিয়ে আঘাত করেছিলেন এক কয়েদি। ওই কয়েদি কারাগারের অভ্যন্তরে মাদকের কারবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জেলা কারাগারের একটি সূত্র বলছে, কারাগারের অভ্যন্তরে দায়িত্ব পালনকারী কারারক্ষীরা ‘জেলবাবু’ নামে পরিচিত। অনেক জেলবাবু সরাসরি মাদক সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত। কারাগারে মাদক যায় দুভাবে।
বগুড়া জেলা কারাগারে অবাধে মাদক প্রবেশ করছে, এই অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০১৮ সালে বগুড়ার আলোচিত ছাত্রী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলার আসামি বহিষ্কৃত শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের বিরুদ্ধেও কারা অভ্যন্তরে মাদক সেবনের অভিযোগ ছিল। ওই ঘটনার পর তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
কারাগারের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, গত অক্টোবরে বগুড়া জেলা কারাগারের একজন কারারক্ষীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে জানা গেছে, তিনি কারা অভ্যন্তরেই মাদক সেবন করতেন। ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজেও ওই দুই কারারক্ষীকে মাদক সেবন করতে দেখা গেছে। কারা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও এই তথ্য উঠে আসে।
এদিকে হত্যা মামলার দুজন আসামির সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো, যাঁরা এক বছরের বেশি সময় বগুড়া কারাগারে ছিলেন। তাঁরা সম্প্রতি কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। দুজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা নিজেরা মাদক সেবন করতেন। কারারক্ষীদের মাধ্যমেই মাদক পেতেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কয়েক গুণ বেশি টাকা গুনতে হতো।
এমনও অভিযোগ আসে, বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে কারা অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহ করা হয়। তবে হাতেনাতে এখন পর্যন্ত কাউকে ধরা যায়নি।বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম
কারাগারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিসহ নানা সমস্যাসংক্রান্ত বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য বগুড়া জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি ত্রৈমাসিক কারা পরিদর্শন কমিটি রয়েছে। এই কমিটিতে জেলা প্রশাসক ছাড়া সিভিল সার্জন, সমাজসেবা কর্মকর্তাসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকজন প্রতিনিধি রয়েছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রতি মাসে কারাগার পরিদর্শন করে।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এমনও অভিযোগ আসে, বাইরে থেকে ঢিল ছুড়ে কারা অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহ করা হয়। তবে হাতেনাতে এখন পর্যন্ত কাউকে ধরা যায়নি।
টাকা দিলে আয়েশে থাকা যায়
বগুড়ার শাজাহানপুর থানার একটি হত্যা মামলার আসামির সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তিনি ১১ মাস কারাগারে থেকে সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছেন। তিনি বলেন, বগুড়া জেলা কারাগারে টাকা দিলে সব পাওয়া যায়। অনেক প্রভাবশালী আসামি ওয়ার্ডে না থেকে অসুস্থতার অজুহাতে কারাগারের মেডিকেল ওয়ার্ডে থাকেন। ওই ওয়ার্ডে ভালো খাবার, আলাদা বিছানা পাওয়া যায়। চাইলে সেখানে নির্বিঘ্নে মাদক সেবনও করতে পারেন। সেবার জন্য আলাদা লোকও থাকে।
ওই আসামি অন্তত ছয়জন প্রভাবশালী ব্যক্তির কথা বলেছেন, যাঁরা অসুস্থতার অজুহাতে ওয়ার্ডে ছিলেন। এর মধ্যে ওই আসামির একজন রাজনৈতিক বড় ভাই ছিলেন, যিনি কারাগারে থাকার পুরো সময় মেডিকেল ওয়ার্ডে থেকেছেন।
কারাগারের একটি সূত্রও প্রথম আলোকে বলেছে, কারাগারে অনেক ব্যক্তি অসুস্থ হলেও মেডিকেল ওয়ার্ডে জায়গা পান না। কারণ, পুরো মেডিকেল ওয়ার্ডের বেডগুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে থাকে। আবার এসব আসামির সঙ্গে যে কেউ যেকোনো সময় দেখা করতেও আসতে পারেন।
বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করে কারা অভ্যন্তরের অবকাঠামো এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও কিছু সমস্যার সমাধান করা হয়।জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
বগুড়া জেলা কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়েছিল জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, পুরো কারাগারের ভেতরে একটিমাত্র দেয়াল রয়েছে। কারাগারের অভ্যন্তরে আরও একটি দেয়াল তৈরি করা প্রয়োজন বলে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের ওই কর্মকর্তার ভাষ্য, এই কারাগার ব্রিটিশ আমলের হওয়ার কারণে করতোয়া ভবন এবং কনডেমড সেলগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। করতোয়া ভবনটি সংস্কার করা হলেও কনডেমড সেলগুলো ছিল একেবারেই নিরাপত্তাহীন। তা ছাড়া একটি কনডেমড সেলে চারজন ফাঁসির আসামি রাখাও ঠিক হয়নি। এটিও ভয়াবহ নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার বগুড়া জেলা কারাগারের জেল সুপার ও জেলারের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হয়; কিন্তু তাঁরা ফোন ধরেননি। পরে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য চাওয়া হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন সময় পরিদর্শন করে কারা অভ্যন্তরের অবকাঠামো এবং নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও কিছু সমস্যার সমাধান করা হয়।