সীমান্তে গরু–মাদক চোরাচালানে ‘পাইলট’ প্রথা

সীমান্তে চোরাচালানের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বর্তমান সংসদ সদস্য ও ওসির তিনটি পক্ষ রয়েছে।

বক্তব্য দিচ্ছেন রৌমারী থানার ওসি আবদুল্লা হিল জামান। পেছনে থানার ‘পাইলট’ মিস্টার (চেক টি–শার্ট পরা)
ছবি: সংগৃহীত

সীমান্তপথে চোরাচালান তদারককারীদের বলা হয় ‘পাইলট’। কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে ‘পাইলট’ প্রথার মাধ্যমে চোরাচালান হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে এত দিন ছিল ‘গোপনে’। ২০০৮ সালে রৌমারী উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন কুড়িগ্রাম-৪ (রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে ‘পাইলট’ প্রথা প্রকাশ্যে আসে। পাইলটরা চোরাকারবারি ও থানা-পুলিশের সঙ্গে সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন।

রৌমারীর বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি ও কয়েকজন সরকারি দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে থানার পাইলট ঠিক করে দিতেন সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসানের (পলাশ) বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছে।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। তিনি অবশ্য প্রথম আলোর কাছে রৌমারী থানার ওসি আবদুল্লা হিল জামানের বিরুদ্ধে ‘বখরা’ নিয়ে গরু ও মাদক চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। গত ২২ জুন উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক আলোচনা সভায় পুলিশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য দেন জাকির।

রৌমারীর স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, সীমান্তে চোরাচালানের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী, বর্তমান সংসদ সদস্য ও ওসির তিনটি পক্ষ হয়েছে। এরই মধ্যে রাজনৈতিক পক্ষ ‍দুটির মধ্যে হামলা ও মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী রৌমারী উপজেলা। ভারতের সঙ্গে রৌমারীর সীমান্ত এলাকা রয়েছে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দাঁতভাঙ্গা, শৌলমারী, রৌমারী সদর ও যাদুরচর ইউনিয়নের ১৯টি পয়েন্ট দিয়ে গরু ও মাদকদ্রব্য পাচার হচ্ছে।

গরু পাচার

সরেজমিনে ১ ও ২ জুলাই দাঁতভাঙ্গার ধর্মপুর, ছাটকড়াইবাড়ি ও চর গয়টাপাড়া সীমান্ত এলাকায় গিয়ে পাঁচ গরু পাচারকারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা মূলত গরু চোরাকারবারিদের (মহাজন) শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁরা কাঁটাতারের ওপর দিয়ে গরুকে পার করার জন্য বাঁশের তৈরি কপিকল (স্থানীয় ভাষায় আরকি) দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার করেন।

এই পাচারকারীদের তথ্যমতে, ১ জুলাই দাঁতভাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে গরু এসেছে ৩১৫টি। তাঁদের ভাষ্যমতে, শীত ও ভারী বৃষ্টির রাতে আরকির মাধ্যমে বেশি গরু পাচার হয়। এ ছাড়া সাহেবের আলগা নামে একটি স্থান দিয়ে নদীপথেও গরু আসে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের ইটালুকান্দা থেকে রৌমারী সদরের খাটিয়ামারী পর্যন্ত ৫৬টি আরকির দলের তথ্য পাওয়া গেছে। একটি আরকিতে কমপক্ষে ২০-২৫ লোক থাকেন। দুটি গরু পার করলে একজন শ্রমিক ৭-৮ হাজার টাকা পান। কেউ জীবিকার তাগিদে, কেউবা বেশি টাকা উপার্জনের লোভে এ কাজে যুক্ত। রৌমারীর স্থানীয় ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি ও তিনজন সাবেক পাইলট এই তথ্য দেন।

জানা গেছে, এ এলাকায় শতাধিক গরু চোরাকারবারি আছেন। তাঁরা কাঁটাতারের ওপারের ভারতীয় চোরাকারবারিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে গরু পাচার করেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাই পথে গরু আনতে গিয়ে গত আট বছরে (২০১৬-২০২৪) কেবল রৌমারী সীমান্তেই বিএসএফের গুলিতে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অন্তত ৪৮ জন আহত ও বিকলাঙ্গ হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন ও ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও রৌমারী থানা-পুলিশ গত চার বছরের (২০২০-২৩) হিসাব দিয়ে বলেছে, নিহতের সংখ্যা ৫।

পাইলটপ্রথা

চোরাচালান ও থানাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইলটরা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে দুটি গরু বাবদ থানার জন্য ৬০০ করে টাকা নিচ্ছেন। দাঁতভাঙ্গা ও শৌলমারী রুটের দুজন সাবেক পাইলট প্রথম আলোকে বলেন, মাসিক চুক্তি অথবা পাচার করা গরুর সংখ্যা হিসাবে থানায় ‘বখরা’ দিতে হয়। পাইলটরা গরু ছাড়াও মাদকদ্রব্য, চিনি, জিরা, শাড়ি-কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের চোরাচালানের টাকাও তোলেন।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের সময়ে দাঁতভাঙ্গার আমির হামজা, শৌলমারীর করিম শহীদ, আবদুল আজিজ, ছক্কু মিয়া, ঝাউবাড়ির গোলাম হোসেন প্রমুখ থানার পাইলট ছিলেন। তাঁরা ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে আছেন। কিন্তু এবার জাকির হোসেন দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁর লোকজন বাদ যায়। জাকির হোসেন অবশ্য দাবি করেন, আমিরের মতো কিছু দলীয় কর্মীকে তিনি সুবিধা করে দিয়েছেন।

বর্তমানে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লতিফ উল হাসান ওরফে লালন দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নে থানার পাইলটের দায়িত্বে আছেন বলে প্রথম আলোকে জানায় থানা ও স্থানীয় সূত্র। দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লালন সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসানের ‘ডান হাত’ হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি উপজেলার চোরাচালান ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে লালনের দাবি, তিনি পাইলট নন।

লালন ছাড়াও চরের গ্রাম ও কাউয়ার চর পয়েন্টে জহুরুল হক, খাটিয়ামারী, বেহুলার চর ও নওদাপাড়ায় রফিকুল ইসলাম ও মিস্টার এবং ঝাউবাড়ি গ্রামে মো. শহিদ সংসদ সদস্যের লোক পরিচয়ে পাইলটের দায়িত্ব পেয়েছেন।

এ বিষয়ে সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসানের দাবি, তিনি ভেবেছিলেন চোরাচালান রোধে থানার প্রতিনিধিরা কাজ করেন। সে জন্য অনেককে প্রতিনিধি হতে বলেছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় গত মাসে লালনের পাইলটের দায়িত্ব বন্ধ করতে তিনি পুলিশকে বলেছেন। বিপ্লব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মিস্টার তাঁর বন্ধু কিন্তু পাইলট নয়। আর জহরুল তাঁর লোক নয়।

ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ

সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের দাবি, রৌমারী সীমান্ত দিয়ে গরু ও মাদক আসছে প্রকাশ্যে। কিন্তু পুলিশের তৎপরতা নেই। ‘পাইলট’ ছাড়াও ওসি আবদুল্লা হিল জামান নিজেই চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জাকিরের ভাষ্য, ‘আগের ওসির এক রেট (মাসোয়ারা ও গরুপ্রতি) ছিল, এই ওসি এসে রেট বাড়ায় দিছে।’

আবদুল্লা হিল জামান অবশ্য গরু চোরাচালান নিয়ে দুই রকম বক্তব্য দেন। প্রথমে তিনি বলেন, তিনি আসার পর চোরাচালান বন্ধ করেছেন। আবার বলেন, ‘যেটা চলছে (থানার পাইলট), সেটা নতুন সেটআপ। জাতীয় নির্বাচনের ১০-১৫ দিন পর শুরু হয়েছে।’

ওসির দাবি, পাইলটের মাধ্যমে থানায় কোনো টাকা আসে না। তাহলে রেট বাড়িয়েছে কে, এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লা হিল জামান বলেন, ‘সেটা তিনি বলতে পারবেন না। তাঁর বাধ্যবাধকতা আছে।’

দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের কাউনিয়ার চরের বাসিন্দা রাকিব হাসান ওরফে রকি গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত থানার ‘পাইলট’ ছিলেন। এ জন্য ওসিকে মাসিক চুক্তিভিত্তিক টাকা দেন রাকিব। অনুসন্ধানকালে সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে রাকিবের সঙ্গে কথা বললে তিনি ঘটনা স্বীকার করেন।

তবে ওসিকে মাসিক কত করে টাকা দিতেন, জানতে চাইলে রাকিব বলেন, ‘এটা বললে ভবিষ্যতে থানাত যাবার পাবার নই।’

অবশ্য ওসি আবদুল্লা হিল জামানের দাবি, রাকিব নির্বাচনের আগে এক মাস থানার পাইলট ছিল। তবে মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।

পাইলটের মাধ্যমে চোরাকারবারির সঙ্গে ওসির সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মাদকে ভাসছে রৌমারী

সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় রৌমারীতে আগে থেকেই মাদক পাচারের রুট ছিল। তবে ২০২১ সালে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রৌমারী উপজেলা বাংলাদেশে ইয়াবার নতুন প্রবেশপথ হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের ইয়াবার চালান রৌমারী দিয়ে বাংলাদেশে পাঠাতে মাদক পাচারকারী চক্রগুলো ভারতের মিজোরাম, মেঘালয় ও আসামকে রুট করেছে।

সীমান্ত এলাকাগুলো ঘুরে জানা গেছে, এই পথে নিয়মিত ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্যের বড় চালান আসছে। কিন্তু ধরা পড়ে কম। উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তথ্য পাচারের ও মাদকদ্রব্য আত্মসাতের।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২ মার্চ রৌমারীর কর্তিমারীতে পুলিশ ভন্দুরচরের ‘ইয়াবা ডিলার’ ধুলু মিয়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। একটি সূত্রের বর্ণনামতে, সেখানে সাতটি কার্টনে অন্তত ৭০ হাজার পিস ইয়াবা বড়ি ছিল। কিন্তু পুলিশের জব্দ তালিকায় ১৬৫ পিস ইয়াবা বড়ি দেখানো হয়।

এদিকে গত ৯ মার্চ কর্তিমারীর নুরুন্নবী মিয়ার বাড়িতে পুলিশ মাদকবিরোধী অভিযানে গেলেও আগেই তথ্য পাচার করা হয়। সংসদ সদস্য বিপ্লব হাসানেরও দাবি, নুরুন্নবী ও রতনপুরেরও এক মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে পুলিশের অভিযানে তথ্য আগেই পাচার হয়। এ বিষয়ে ওসি আবদুল্লা হিল জামানের দাবি, দুটি ঘটনায় সময় তিনি রৌমারীর বাইরে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে অবগত নন।

থানা-পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলোর তথ্যমতে, ২০১৮ সালে একটি গোয়েন্দা সংস্থা রৌমারীতে মাদকের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়। এ ছাড়া ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগানো মাইক্রোবাসে ইয়াবাসহ র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন জাকির হোসেনের ব্যক্তিগত চালক রফিকুল ইসলাম।

জাকির হোসেন অবশ্য মাদকের পৃষ্ঠপোষক নন বলে দাবি করেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স। অথচ ওরা বলে, আমি মাদক ব্যবসায়ী। মাদকের গডফাদার।’

স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আফজাল হোসেন (বিপ্লব) চোরাকারবারিদের হয়ে থানায় ‘তদবির’ করেন। তবে আফজালের দাবি, তিনি কোনো অবৈধ বা অনৈতিক কাজে জড়িত নন।

গত ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারীতে যান এই প্রতিবেদক। এ সময় তিনি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে মাদক সেবনের তৎপরতা দেখতে পান। ১ জুলাই রাতে থানা মোড়ে কফিল উদ্দিনের দোকানের সামনে তিনটি ভারতীয় মদ ‘অফিসার চয়েজে’র খালি বোতল পড়ে ছিল। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী তা দেখিয়ে বললেন, ‘থানার সামনে মদের বোতল পড়ে আছে। বুঝে নেন, পুরো রৌমারীর কী অবস্থা।’

রৌমারীতে মাদকের পৃষ্ঠপোষকেরা রাজনৈতিক প্রশ্রয় পাচ্ছেন, এমন মনে করেন সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সংগঠন মুক্তাঞ্চলের পরিচালক মো. আকতারুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যুবসমাজ বিশেষ করে কিশোরেরা মাদকের প্রভাবে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। এর প্রতিকারে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করতে হবে।