জঙ্গি সংগঠন শারক্কীয়ার সামরিক প্রশিক্ষণের ভিডিও নিয়ে যা বলল র্যাব
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র্যাব। আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সেই ভিডিও সাংবাদিকদের সামনে প্রদর্শনও করা হয়। পরে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে র্যাব আরও বিস্তারিত জানিয়েছে।
র্যাব বলছে, গতকাল সোমবার ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পাশের জঙ্গল থেকে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ও তাঁর সহযোগী আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসুকুর রহমানের কাছ থেকে একটি মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। সেই মুঠোফোনেই পার্বত্য অঞ্চলে সংগঠনটির সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। ভিডিওতে যেসব দৃশ্য দেখা গেছে, তা ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উদ্ধার হওয়া ভিডিওতে জঙ্গিদের কয়েকটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প দেখানো হয়েছে। এসব ক্যাম্প বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চলে। এই ভিডিওতে ‘অভিনয়’ করেছেন সংগঠনটির সদস্যরা, যাঁরা স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। ভিডিওর শুরুতেই জামাতুল আনসারের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদকে দেখা গেছে। ঠিক তাঁর পেছনেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এক প্রশিক্ষককে দেখা গেছে।
বিভিন্ন ক্যাম্পে সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা দুই সদস্যকে দেখা গেছে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, ভিডিওতে সাব্বির ওরফে কারসে এবং দিদার ওরফে চাম্পাইকে দেখা গেছে। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সামরিক কার্যক্রম বা প্রশিক্ষণ দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দুটি ভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুজনকে। আর পুরো সামরিক কার্যক্রম দেখভাল করতেন গতকাল গ্রেপ্তার হওয়া সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান। ভিডিওতে সালেহ ও আল-আমিন নামে আরও দুজনকে দেখা গেছে। কয়েক দিন আগে এই সালেহ বান্দরবানে শারক্বীয়ার দুই সদস্যের কবরের সন্ধান দিয়েছিলেন।
ভিডিওতে যা দেখানো হয়েছে
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমানকে এই ভিডিও করার কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। মূলত রণকৌশলগত চলাচল, চলতি পথে অস্ত্র বহন, টহলকালীন ও ব্লক করার সময় তাদের অবস্থান কেমন হবে, সেগুলো তারা ভিডিওতে রেখেছে। শত্রুর ক্যাম্পে হানা দেওয়ার সময় কীভাবে ৩৬০ ডিগ্রির কৌণিক দূরত্বে সদস্যরা অবস্থান করবেন, সেই অভিযানকারী মহড়া রেখেছে ভিডিওতে। মাটির মধ্যে ম্যাপ এঁকে কার অবস্থান কোথায় হবে, সেটি বোঝানোর একটি দৃশ্য দেখা গেছে।
ভিডিওতে জঙ্গি সংগঠনটির সদস্যদের শারীরিক কসরত ও ফিটনেস গুরুত্ব পেয়েছে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিযান চলাকালীন বিভিন্ন ধরনের সংকেত যেমন থামা, কাছে ডাকা, দলগত অবস্থান, ধীরে চলা, এককভাবে চলা ইত্যাদি সংকেত দিতে দেখা গেছে। এ ছাড়া অভিযানের সময় কীভাবে অস্ত্র বহন করবে, অস্ত্র বহনের সময় হাত, হাতের আঙুল কোথায় থাকবে, কীভাবে রাতের আঁধারে পথ চলতে হবে ইত্যাদি প্রশিক্ষণ ভিডিওতে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
এই ভিডিও করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো, যাঁরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আছেন এবং প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তাঁদের আরও উদ্বুদ্ধ করতে এই ভিডিও করা হয়। সংগঠনটির সামরিক শাখায় যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তাঁদের করণীয় কী হবে সেই বিষয় সামনে রেখেই এই ভিডিও করা হয়েছে। সমতলে অবস্থানকারী বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভিডিও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করাও ছিল তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের অভিযান সম্পর্কে যা জানাল র্যাব
র্যাব জানায়, গত বছরের ২০ অক্টোবর জামাতুল আনসারের সামরিক শাখার উপপ্রধান মারুফ আহমেদসহ সাতজন এবং কেএনএফের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন ২১ অক্টোবর তাঁদের বিরুদ্ধে রাঙামাটির বিলাইছড়ি থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়। ওই মামলায় ১৭ জানুয়ারি আদালত তাঁদের ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমানের কার্যক্রম ও সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। পরে গোয়েন্দা তথ্যে নিশ্চিত হওয়া যায়, মাসুকুর রহমান এবং তাঁর সহযোগী বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অবস্থান করছেন। পরে গতকাল সোমবার ভোরে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পাশের জঙ্গল দিয়ে পালানোর চেষ্টাকালে তাঁদের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মাসুকুর রহমান সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন বলেন, মাসুকুর সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধানের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি শুরা সদস্য। ২০০৭ সালের আগে তিনি পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন এলাকায় ডাকাতি করতেন। ডাকাতি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় কারাগারেও গিয়েছেন। কারাগারে থাকাকালে তিনি জেএমবির মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে জেএমবির কার্যক্রমে যুক্ত হন।
২০১৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে যোগ দেন। ২০২১ সালে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সময় মাসুকুর উপস্থিত ছিলেন। পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের রূপরেখা নির্ধারণেও তিনি ভূমিকা রাখেন।