ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে খুনের ঘটনায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের বিভিন্ন উপায়ে ভারতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে কিডনি রোগী ও ফয়সাল আলী ওরফে সাজীকে হৃদ্রোগের রোগী সাজানো হয়। এমনকি তাঁদের ভুয়া পরিচয়ও ব্যবহার করা হয়। ইজিবাইকচালক মোস্তাফিজুরকে ‘জিএস ফুড প্রোডাক্টস’ নামের একটি কোম্পানির প্রকৌশলী এবং ট্রাকচালক ফয়সালকে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মী পরিচয় দেওয়া হয়।
আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত হিসেবে চিহ্নিত দুই আসামি মোস্তাফিজুর ও ফয়সালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
গত ২৬ জুন সীতাকুণ্ডের পাহাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল। এর পরদিন আদালতের মাধ্যমে তাঁদের ছয় দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। গত মঙ্গলবার মোস্তাফিজুর আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আর ছয় দিনের রিমান্ড শেষে আজ বুধবার ঢাকার আদালতে ফয়সাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
ডিবি ও আদালত সূত্রে জানা যায়, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের সহকারী (পিএস) মো. সিয়াম হোসেন এই দুজনের ভারতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেন। এই দুজনের পাসপোর্ট করার জন্যও ভুয়া পরিচয় তৈরি করে দেন তিনি। এ ছাড়া চিকিৎসার নামে ভারতে যাওয়ার ভিসা পেতে মোস্তাফিজুর ও ফয়সালের জন্য চিকিৎসকের ভুয়া ব্যবস্থাপত্র তৈরি করা হয়। এসব কাগজপত্র এখন ডিবির হাতে রয়েছে।
এই দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে ডিবি সূত্র জানায়, কলকাতায় যাওয়ার জন্য তাঁদের খুলনা থেকে ঢাকায় এনে পাসপোর্ট তৈরি করে দেন আক্তারুজ্জামান। এরপর ২ মে ট্রেনে করে তাঁদের ভারতে পাঠান। তাঁরা ভারতে গিয়ে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়ার কথা অনুযায়ী নিউমার্কেটের একটি হোটেলে ওঠেন। সেখান থেকে সঞ্জিভা গার্ডেন্সের ফ্ল্যাটে গিয়ে ১৩ মে সংসদ সদস্য আনোয়ারুলকে তাঁরাসহ কয়েকজন মিলে হত্যা করেন। ১৯ মে দুজন ঢাকায় ফিরে আসেন।
সংসদ সদস্য খুনে মোস্তাফিজুর ও ফয়সালের ভূমিকা নিয়ে ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আগে জানিয়েছিল, আনোয়ারুল আজীমকে অচেতন করতে চেতনানাশক ব্যবহার করেছিলেন ফয়সাল। অন্যদিকে খুনের আগে আনোয়ারুলকে চেয়ারে বেঁধে ফেলার কাজটি যাঁরা করেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মোস্তাফিজুরও।
কলকাতা পুলিশ সূত্র জানায়, যেদিন আনোয়ারুল খুন হন, সেদিন বেলা ১টা ৪০ মিনিটে কলকাতার বরাহনগরের মণ্ডলপাড়া লেনের বন্ধুর বাসা থেকে বের হয়ে একটি গাড়িতে ওঠেন তিনি। ওই গাড়িতে আগে থেকেই ছিলেন ফয়সাল। তিনি সংসদ সদস্যকে নিয়ে নিউ টাউন এলাকার ‘অ্যাক্সিস মল’-এর কাছে যান। বেলা ২টা ৪০ মিনিটে দুজনই গাড়িটি থেকে নেমে অন্য আরেকটি গাড়িতে ওঠেন। তখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন শিমুল ভূঁইয়া। দ্বিতীয় যে গাড়িতে আনোয়ারুল উঠেছিলেন, সেই গাড়ি মোস্তাফিজুরকে নিয়ে ভাড়া করেছিলেন ফয়সাল। এই তিনজন (আনোয়ারুল, মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল) বেলা ৩টা ৫ মিনিটে নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসে যান। পরে তাঁরা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। এই ফ্ল্যাটে খুন হন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল।
সংসদ সদস্য খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া, তাঁর ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া ও খুনের সময় কলকাতায় অবস্থান করা আরেক নারী শিলাস্তি রহমান আগেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এবার গ্রেপ্তার হলেন মোস্তাফিজুর ও ফয়সাল। দুজনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। শিমুলের বাড়িও একই এলাকায়। খুনের এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম (মিন্টু) এবং একই কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদকেও গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। সাইদুল করিম ছাড়া প্রত্যেকে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৯ জন গ্রেপ্তার হলেন। এর মধ্যে ভারতে আছেন দুজন।